এই বেশি মানুষের অংশগ্রহণ ঝুঁকিও বাড়িয়েছে। এমনিতে মানুষ বেশি থাকলে নিরাপত্তা ঝুঁকি কমে যায়। নিরিবিলি জায়গার চেয়ে জনবহুল জায়গায় আমি বেশি নিরাপদ বোধ করি। কিন্তু ভিড়টা বেশি বেশি হয়ে গেলে নিরাপত্তা ঝুঁকিটা বেড়ে যায়। সব দেশে, সব সমাজেই মানুষরূপী কিছু পশু থাকে। তারা হয় অন্ধকারে থাকে, নয় অনেক ভিড়ে মিশে থাকে। তাদের টার্গেট নারীরা। ভিড়ের মধ্যে এরা নানা উপায়ে নারীদের হেনস্তা করে। একসময় বইমেলায় প্রবেশ পথে প্রায় নিয়মিতই নারীরা হেনস্তার শিকার হতেন। থার্টি ফার্স্টের আয়োজনেও নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বইমেলা এখন অনেক নিরাপদ। সবাইকে লাইন ধরে সুশৃঙ্খলভাবে বইমেলায় ঢুকতে হয়। বিজাতীয় থার্টি ফার্স্টের আয়োজন এখন অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত ঘরোয়া। কিন্তু বর্ষবরণের বিশাল আয়োজন এখনও অতটা সুনিয়ন্ত্রিত নয়। কয়েক বছর ধরেই বর্ষবরণের আয়োজনে ভিড়ের মধ্যে নারী হেনস্তার ফিসফাস শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু গতবছর ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লিটন নন্দী নির্যাতনের হাত থেকে কয়েকজন নারীকে বাঁচানোর পর এই অন্ধকার দিকে সবার নজর পড়ে। এ নিয়ে অনেক হইচই হয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়েনি। এই নারী নিগ্রহে পুলিশের দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব অবশ্যই পুলিশের। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে পুলিশের সামনেই অভিজিত খুন হয়ে যায়, পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। পুলিশের এই নির্লজ্জ নির্বিকারত্বই অপরাধীদের উৎসাহিত করে। লিটন নন্দী ঝুঁকি নিয়ে নারীদের রক্ষা করতে না এলেই সব আগের মতো থাকতো। পুলিশ বলতো সব ঠিকঠাকমত হয়েছে।
পুলিশকে ধন্যবাদ। এবার তারা আগেভাগেই কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই। কান ঝালাপালা করা আফ্রিকান বাঁশি ভুভুজেলা নিষিদ্ধ করা অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু ৫টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশ আর মুখোশ ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা প্রশ্ন তুলেছে পুলিশের দক্ষতা নিয়েই। মাথা ব্যথার সমাধান কখনই মাথা কেটে ফেলা নয়। বাঙালি ঐতিহ্যের অংশ কিনা জানি না। কিন্তু রঙ বেরঙের মুখোশ আমাদের বর্ষবরণের আয়োজনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার অনিবার্য অনুষঙ্গ মুখোশ। মুখোশ দিয়ে শুধু অপরাধীরাই নিজেদের কালো মুখই আড়াল করে না, উৎসবপ্রিয় মানুষও ক্ষণিকের জন্য নিজেদের বদলে নেয়।
তবে ৫টার মধ্যে উৎসব আয়োজন শেষ করার নির্দেশে তীব্র আপত্তি আমার। আমাদের প্রাণের উৎসবে এভাবে বাধ সাধার কোনও অধিকার পুলিশের নেই। পুলিশের দায়িত্ব আমাদের উৎসবকে নিরাপদ করা, বাধা দেওয়া নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীলতা চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের দিকে তাকানোও যেতো না, তখনও কিন্তু মেয়েরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে পুলিশের ১৪৪ ধারা ভাঙার মিছিলে সামনের কাতারেই ছিল মেয়েরা। সকল প্রগতিশীল আন্দোলনেই মেয়েরা ছেলেদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে থেকেছে। এমনকি সামরিক সরকারের আমলে যখন প্রায়শই বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলাগুলি হতো, তখনও মেয়েরা নিশ্চিন্তে হলের গেট বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে। আর এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পেরে আমরা তাদের সন্ধ্যার আগেই ঘরে আটকে ফেলার ব্যবস্থা করছি। আমি কখনই সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার পক্ষে নই, আমি সমস্যা মোকাবেলা করতে চাই। পুলিশের দায়িত্ব আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেটা কীভাবে করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। ব্যাপারটা তো এমন নয় যে গতবছর নির্যাতনকারীরা মুখোশে মুখ ঢেকে, ভুভুজেলা বাজিয়ে রাতে এসেছিল। অপরাধীরা যদি বুঝে যায় সবার সামনে ভিড়ের মধ্যে নারীদের শ্লীলতাহানী করলেও তাদের পুলিশ ধরতে পারবে না, বিচার করতে পারবে না; তাহলে তারা দিনের বেলায় ভরদুপুরে ভুভুজেলা ছাড়া, মুখোশ ছাড়াও তা করতে চাইবে। তাই দরকার কঠোর নজরদারি, আইনের কঠোর প্রয়োগ। পুলিশকে মনে রাখতে হবে, অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না।
পুলিশ মুখে বলেনি বটে, তবে তাদের সব নিষেধাজ্ঞার মূল সুর হলো, নারীরা যেন বর্ষবরণের আয়োজনে কম আসে। এক ধরনের ভয় ধরানোর ব্যাপার আছে। আমি সবসময় বিশ্বাস করি এবং জানি; ভয় দেখিয়ে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মুক্তচিন্তাকে, প্রগতিশীলতাকে, উৎসবমুখরতাকে আটকে রাখা যায় না। আমরা জানি এবার মেয়েরা বান্ধবীদের নিয়ে দল বেধে, একা, বন্ধুর সঙ্গে, প্রেমিকের সঙ্গে, স্বামীর সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে, বোনের সঙ্গে, ভাইয়ের হাত ধরে বর্ষবরণের আয়োজনে আসবে; চমৎকার করে সেজে আসবে, মাথায় থাকবে ফুলের মালা।
সেদিন পত্রিকায় একটি ছবি দেখে আশাবাদী হয়েছি। প্রীতিলতা ব্রিগেডের মেয়েরা আত্মরক্ষার জন্য তায়াকান্দো শিখছে। আমি নিশ্চিত আস্তে আস্তে কারাতে বা তায়াকান্দো শেখা মেয়েদের সংখ্যা বাড়বে এবং তারা নিজেদের তো বটেই আরও অনেককে পাশবিক পুরুষদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে। নিশ্চয়ই লিটন নন্দীর মতো সাহসী পুরুষদেরও পাশে পাবেন তারা। পশুদের ভয়ে আপনারা ঘরে বসে থাকবেন না। পশুর মানসিকতা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এমন পুরুষের সংখ্যা কম। পুলিশের দায়িত্ব পশুদের খাঁচায় আটকে রাখা। আর নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে সবার জন্য উৎসব অবারিত, প্রাণবন্ত করা।
লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।
ইমেল: probhash2000@gmail.com