বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদ কি আবেদন হারাচ্ছে?








বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীনরেন্দ্র মোদি ভারতে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাতে তারা কতটুকু সফল হবেন সম্ভবত তার একটা অনাস্থাসূচক ইঙ্গিত দিলেন ভারতীয় ভোটাররা। হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির হাতে ব্রহ্মাস্ত্র ছিল কাশ্মির। তার সরকার কাশ্মির সম্পর্কীয় শাসনতন্ত্রের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে দিয়েছে পাঁচ আগস্ট ২০১৯। তিন মাস পরে এসে ৩১ অক্টোবর ২০১৯ কাশ্মিরকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভাগ করে কেন্দ্রীয় শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেছে। জম্মু ও কাশ্মির এক অংশ এবং লাদাখ আরেক অংশ। ভারতে জম্মু ও কাশ্মির বলে আর কোনও প্রদেশ থাকলো না।
এটা নিয়ে নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহ কাশ্মির বিজয়ের আস্ফালন নিয়েই হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারণা চালিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, যেখানে বিজেপি আগে এককভাবে সরকার গঠন করেছিল, এবারের নির্বাচনের পর সেখানে তাদের কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হচ্ছে। কারণ, বিজেপি সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
অথচ মাত্র ৬ মাস আগে এ বছরে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩০৩টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া এবং কাশ্মির বিজয়ের আস্ফালনের মুখরিত নির্বাচনি প্রচারণা শেষে এমন ফলাফল প্রাপ্তিকে আমরা কি ধরে নিতে পারি যে ভারতীয় ভোটারদের কিছুটা হলেও চৈতন্য ফিরে আসছে? ভবিষ্যতের ‘আচ্ছে দিন’-এর কথা বলে বর্তমানকে ক্রমাগত সংকটময় করাকে ভোটাররা পছন্দ করছেন না?
৩৭০ ধারা যেমন কাশ্মির প্রসঙ্গে শাসনতন্ত্রে ছিল, রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন সেভেন সিস্টার্স বলে খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্ব কোণের ছোট ছোট রাজ্যগুলোর সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান সৃষ্টির সময়ও ৩৭১ ধারায় বিশেষ সুযোগের কথা সন্নিবেশিত হয়েছিল। সম্ভবত কাশ্মিরের অবস্থা দেখে তারা এখন আস্থাহীনতায় ভুগছে। না হয় মনিপুরীরা সম্প্রতি স্বাধীনতা ঘোষণা করলো কেন! নাগাল্যান্ডের নেতা লালডেঙ্গা দীর্ঘদিন স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছেন। অবশ্য এখন স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে বিরত রয়েছে। মনিপুরীরা স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর নাগাল্যান্ড যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবে না তার নিশ্চয়তা কি!
ভারতের মোট ১৩৪ কোটি জনসংখ্যার মাঝে হিন্দু ৯৬ কোটি। সেখানে আবার প্রায় ৩৫ কোটি নমশূদ্র। শূদ্রদের মাঝে আছে ১০ কোটি লোক যারা জাতিভ্রষ্টদের জনগোষ্ঠী। তাদের শূদ্ররাও শূদ্র হিসাবে গ্রহণ করে না। এত ভেদাভেদের মাঝে জাতীয় ঐক্য কতটুকুই বা সুদৃঢ়। সঙ্গত কারণেই ভারতের স্থপতিরা বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের কথা বলেছেন। এছাড়া উপায়ও বা কী ছিল! ব্রাহ্মণেরা উচ্চবর্ণের মানুষ। তারা ব্রহ্মার শ্রীমুখ থেকে জাত হয়েছেন। আর সেই ব্রাহ্মণদের সাব-কাস্ট আছে ১৮৮৪টি।
এ জাতিভেদের প্রতি জওহরলাল নেহরু ‘ডিভিশন অব লেবার’ বলে অস্পষ্ট একটা সম্মতিসূচক কথা লিখেছেন তার লেখায়। শুধু মহাত্মা গান্ধীই এর বিষফল উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, যার কারণে হরিজন (ভগবানের সন্তান) বলে আখ্যায়িত করে তিনি দিল্লির দাঙ্গর মহল্লায় গিয়ে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে, আহার বিহার করে তাদের ভয় ভাঙিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করেছিলেন।
অত্যন্ত বেদনার কথা যে মায়াবতী আর আম্বেদকর, যারা অস্পৃশ্যদের সন্তান, তারাই গান্ধীকে বড় বড় কথা বলেছেন। অথচ নেহরু ও প্যাটেলকে গান্ধী বলেছিলেন আম্বেদকরকে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান করতে। আরও বলেছিলেন তোমরা একজন হরিজন মহিলাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি করিও।
ছোটরা বড় হলে নিজেদের সমানে আনতে প্রকৃত বড়দের কেটে সাইজ করার চেষ্টা করেন। আম্বেদকর আর মায়াবতী তা-ই করেছিলেন। অথচ জগজীবন রাম গান্ধীর প্রতি সারা জীবন অশেষ শ্রদ্ধাবোধ রেখে চলেছেন। কারণ, গান্ধীর মমত্ববোধের কারণে জাতিভ্রষ্টরা বহুদূর এগিয়ে ছিলেন। জগজীবন রামও জাতিভ্রষ্টদের সন্তান।
যাক, বলেছিলাম ভারতের লোকসংখ্যার কথা। ১৩৪ কোটি মানুষের মাঝে ৯৬ কোটি হিন্দু, বাকিরা অন্য ধর্মাবলম্বী। কুলদীপ নায়ারের লেখায় পড়েছি মুসলমানের সংখ্যা ৩০ কোটি। অবশ্য সরকারি হিসাব তা বলে না। ভারতের মুসলমানরা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম। কোনও দেশে বৃহত্তর মুসলিম সংখ্যালঘুও তারা। ব্রিটিশের সময়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন পৃথক রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপন করেছিলেন তখন ব্রিটিশ আর কংগ্রেস তা মানতে চায়নি। জিন্নাহ যখন প্রেস কনফারেন্স করে বললেন, আমাদের দাবি যদি মানা না হয় তবে আমরা প্রয়োজনে গৃহযুদ্ধ করবো আর পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করবো। তখন ব্রিটিশ আর কংগ্রেস তার দাবি মেনে নিয়েছিল।
‘দ্য লাস্ট ডেজ অব ব্রিটিশ রাজ’ লেখক লিওনার্ড মোসলে বড়লাটের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বড়লাটের সেরেস্তায় পাকিস্তান সম্পর্কে কোনও ফাইল খোলা হয়নি। অথচ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।
হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিপক্ষ মুসলমান। হিন্দুত্ববাদীরা পণ করেছে ভারতের মাটি থেকে মুসলমানদের মূলোৎপাটন করার। মুসলমান এক দুই কোটি নয় যে তাদের ভারতের মাটিতে নিঃশেষ করা সহজ হবে। তারা যদি জিন্নাহর মতো বলে যে প্রয়োজনে তারা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হতেও দ্বিধা করবে না তখন রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা একটা বড় হুমকির মুখে পড়বে। আহমেদাবাদ দাঙ্গার পরে তো লোকসভার সদস্য সাহাবুদ্দিন লোকসভায় বক্তৃতাকালে বলেছিলেন, হিন্দুরা যদি দাঙ্গা করে মুসলিম নিধনের অভ্যাস ত্যাগ না করে তবে আমরা ভারতের ভেতরে মুসলমানদের জন্য আর একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুলবো।
ভারত রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করার এই পরিকল্পনা বিবেকবান হিন্দু ভোটাররা শেষ পর্যন্ত মানবে বলে মনে হচ্ছে না। সম্ভবত তাই তার প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিজেপির পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ হয়তো এটাই।
নয়াদিল্লিতে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে মানুষ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। এখানে আর ‘আচ্ছে দিন’ বলার অবকাশ নেই। দিল্লির চল্লিশ শতাংশ মানুষ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ভারত সফরে আসা জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদিকে পরামর্শ দিয়েছেন সব যানবাহনে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার না করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে।
রাজধানীর আবহাওয়া চরমভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। তা থেকে মানুষকে রক্ষা করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বায়ু দূষণের প্রক্রিয়ায় মানুষ মোটর গাড়ি ব্যবহার করছে না। এর ব্যবহার উঠে যাচ্ছে আর নব সহস্রাব্দের মানুষ মোটর গাড়ি কিনছে না। জনগণকে উবারের মতো অ্যাপস দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। এতে গাড়ি শিল্প বিরাট এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আড়াই লক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। ভারতের মোটর শিল্পের এই দুর্যোগ তাদের অর্থনীতিকে দুর্যোগকবলিত করেছে। নরেদ্র মোদি কীভাবে সামাল দেবেন এই দুর্যোগ!
মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে এনআরসির বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়িতে ব্যস্ত রয়েছেন। একজন ভালো অর্থনীতিবিদ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করতে পারেননি। এখন ভারতের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে নেমেছে। ভারতীয় অর্থনীতি এখন মন্দার কবলে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, এই মন্দা মহামন্দার পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। ড. মনমোহন সিং ৮% প্রবৃদ্ধি রেখে গিয়েছিলেন।
নরেন্দ্র মোদি কোনও মহাপণ্ডিত ব্যক্তি নন। সাধারণ লেখাপড়া করা জানা লোক। ছোট রাজ্য গুজরাটের দুই দুইবার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। গুজরাট ব্রিটিশের সময় থেকে শিল্প উন্নত এলাকা। আহমদাবাদকে তখন থেকে ম্যানচেস্টার বলা হতো। নরেন্দ্র মোদির আগেই ভারতীয় অর্থনীতিতে গুজরাট রাজ্যের ১৭ শতাংশ অবদান ছিল। মোদি ভালো সংগঠক এবং বাকবিভূতিতে তার জুড়ি নেই। তিনি ভালো মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নাম কুড়িয়ে ছিলেন। যে কারণে ভারতের ধনবাদী গোষ্ঠীর কাছে ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন।
নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন কিন্তু ভারতের দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা কোটি কোটি মানুষের কোনও কল্যাণ করতে পারেননি। সুতরাং আগামীতে আর্থিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে ভারতীয় ভোটাররা ভোট প্রদান করলে ফলাফল নরেন্দ্র মোদির পক্ষে থাকার কথা নয়। তিনি হিন্দুত্ববাদের একটা আবেগ সৃষ্টি করেছিলেন সত্য কিন্তু যে আবেগ পেটের ভাত জোগাতে পারে না সে আবেগ অন্তঃসারশূন্য বলে নিশ্চয়ই পরিত্যাজ্য হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com