সুখে থাকতে ভূতে কিলায়!

চিররঞ্জন সরকারসুখে থাকতে ভূতে কিলায় বলে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে। এটি একটি চমকপ্রদ বাক্য। মানুষের আকাঙ্ক্ষা হলো—সুখ। সেই সুখ যে পেয়ে যায়, সে বিগড়ে যাবে! তাই কি সম্ভব? না তা হয় কখনও? সবার আগে আমাদের জানা দরকার, সুখ জিনিসটা কী? সুখ আসলে কী—তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেকে মনে করেন চাহিদা তত্ত্বের শিখরে পৌঁছলেই সুখ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যালথাস এই তত্ত্বকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন এবং পাঁচ স্তরের চাহিদা তত্ত্বের সূত্র দেন। যেখানে তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে মানুষের চাহিদা একটা পূরণ হবার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি উন্নত চাহিদা তার সামনে এসে হাজির হয়। সুতরাং কোনও একটি নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণ হলেই সুখের নাগাল পাওয়া গেল তা বলা যাবে না।
আপাতদৃষ্টিতে সুখ একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। এটা একটা অনুভব, অনুভূতি। সুখের অনুভূতি প্রসঙ্গে একজন লিখেছিলেন, মাঘ মাসের শীতে রাতে লেপের ভেতর থেকে একটি পা কিছুক্ষণ বাইরে রাখার পর সেটা আবার লেপের ভেতর নেয়ার পর যে অনুভূতি, তাই হচ্ছে সুখ! কোনও একটি নির্দিষ্ট প্রয়োজনে কতটুকু প্রাপ্তিতে একজন সন্তুষ্ট হবেন তার ওপর সুখ নির্ভর করে। ধরা যাক, একজন ব্যক্তির অর্থনৈতিক সক্ষমতায় তিনি একটি সাইকেল কিনতে পারবেন। কিন্তু তিনি যদি আফসোস করেন, কেন একটি মোটর সাইকেল কিনতে পারলেন না— তাহলে তিনি অসুখি। আর যদি কেউ তার যা সামর্থ্য আছে তাতেই তুষ্ট থাকেন অর্থাৎ ওই সাইকেলেই যদি একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে তৃপ্ত হতেন তাহলে তিনি সুখ খুঁজে পেতেন।
কে কীসে সুখি হন—তা বলা কঠিন। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, 'কেউ হাসি চায়, কেউ ভালবাসা, কেউ চায় মিঠে কথা/ কেউ চায় ফের নয়নের জল, কেউ চায় এর ব্যথা'। অর্থাৎ কে কী চায় তা যেমন আমরা বলতে পারি না, কে কীসে সুখি হয় তাও আমরা বলতে পারব না। মানুষের চাওয়াও যেমন বিচিত্র, সুখি হওয়ার উপকরণ বা কারণও তেমনি বিচিত্র।
সুখের সংজ্ঞা বুঝুক না বুঝুক, সুখ কী জানুক না-জানুক মানুষ সুখ চায়, সুখি হতে চায়। কিন্তু কেউ সুখি হয় কেউ হয় না। এ নিয়ে মানুষের হাহাকার আছে, অনুশোচনা আছে, আছে আক্ষেপ, দীর্ঘশ্বাস। যদিও কবি কামিনী রায় উপদেশ দিয়েছেন, 'সুখ সুখ করে কেঁদো না আর, যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে, ততই হবে হৃদয় ভার।' কিন্তু কে শোনে কার কথা! সুখ সুখ করে আমরা যেমন কেঁদে বেড়াই, আবার অনেক সময় একটু সুখের দেখা পেলেই তা হারাতে ব্যাকুল হয়ে যাই!

সুখ কী, সুখে থাকতে কেন ভূতে কিলায়—এসব নিয়ে অনেক তর্ক আছে। তারপরও বাস্তবতা হলো, আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাদের সত্যিই সুখে থাকতে ভূতে কিলায়।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথাই চিন্তা করুন। আন্দোলনের নামে জুলুম, বোমাবাজি, নৈরাজ্য, মানুষ হত্যার একটা দীর্ঘ অসহনীয় কাল পেরিয়ে আমরা মোটামুটি একটা স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছেছি। সদ্য পৌরসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে। মহা ধুমধাম করে আমরা ইংরেজি নববর্ষ পালন করেছি। প্রকৃতিতে চলছে শীতকাল। লেপ আর কম্বলের ওমে আমাদের মধ্যবিত্ত হৃদয় যখন তৃপ্ত শান্ত, ঠিক তখনই বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যাদিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চায়। তবে এই ‘গণতন্ত্র হত্যাদিবস’ কথাটির মধ্যেই একটা কেমন ঝগড়া ঝগড়া ভাব আছে। কেন বাবা, গণতন্ত্রকে যদি ‘হত্যা’ই করা হয়, তাহলে শ্রাদ্ধ, মিলাদ, চল্লিশা, চেহলাম হতে পারে, ‘হত্যাদিবস’ পালন কেন? আর এই দিবস পালন করে ‘যে খুন হয়েছে’ সেই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনা যাবে? আর তাকে যদি ফিরিয়ে আনা না-ই যায়, তাহলে মিছেমিছি এই ‘হত্যাদিবস’ পালনের মানে কী? তা ছাড়া একটি সমাবেশ করলেই কি এই সরকারের পতন হবে? তাহলে সমাবেশ নিয়ে খামোখা কেন উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে?

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশের কথা শুনে আওয়ামী লীগও কাছা খুলে মাঠে নেমেছে। তারাও একই দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। এখন উভয় দলই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার জন্য পুলিশ প্রশাসনের কাছে অনুমতি চেয়েছে। শান্ত দেশে আকস্মিকই উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। আশার কথা হল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি না পেলে উভয় দল নিজ নিজ কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার কথাও জানিয়েছে। তবে পরিস্থিতি যথারীতি উত্তেজনাকর।

এই উত্তেজনা অপ্রয়োজনীয়। এর জন্য বিএনপির পাশাপাশি সরকারি দলেরও দায় আছে। যদিও যুক্তির নিরিখে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে দেখলে বিএনপির দায়টাই বেশি। সমাবেশ বা মহাসমাবেশ আসলে সমস্যা নয়, সমস্যা হল পেট্রোল বোমা। বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের নামে প্রায় বছরব্যাপী পেট্রোলবোমা কর্মসূচির বিভীষিকা এখনও দেশবাসীর মন থেকে দূর হয়নি। আন্দোলনের উদ্দেশ্য যতই মহান হোক, বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারার পর সে উদ্দেশ্য আর মহান থাকে না। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাবেই।

তাছাড়া বিএনপির নেতানেত্রীরা বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা, বুদ্ধিজীবীদের অবদান নিয়ে যে গর্হিত বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে করে বোধবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনও মানুষের বিএনপির পক্ষে সমর্থন জ্ঞাপন করাটা রীতিমত কঠিন হয়ে পড়েছে। পুরোপুরি মিথ্যের উপর দাঁড়িয়ে, আদর্শ ও নৈতিকতা হারিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার পথের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে, যে কোনও যুক্তির সামনে ধর্মকে দাঁড় করিয়ে, মিথ্যা ও গুজব ছড়িয়ে, ষড়যন্ত্রকে প্রশ্রয় দিয়ে বিএনপি এক আত্মঘাতী রাজনীতির চর্চার পথ বেছে নিয়েছে। যতদিন বিএনপি তার এই ভুল ও আত্মঘাতী রাজনীতি চালিয়ে যাবে-ততদিন তারা সফল হতে পারবে না। সুধীজনের সমর্থন পাবে বলেও মনে হয় না। বিএনপি নিজেদের ইমেজ আসলে নিজেরাই ধ্বংস করেছে।

এ পরিস্থিতিতে বিএনপির নেতানেত্রীদের প্রতি অনুরোধ আপাতত ক্ষান্ত দিন। আর তাছাড়া আপনাদের কর্মীরা আন্দোলন করতে করতে ক্লান্ত। অনেকে জেল-জুলুম-হুলিয়া-রিমান্ড-আত্মগোপন-মামলা ইত্যাদিতে শ্রান্ত। সদ্যসমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপিকে কোথাও তেমনভাবে দেখা যায়নি! এ অবস্থায় তাদের পক্ষে আবার আন্দোলনে যাওয়াটা সুখকর নয়। তাদেরও বিশ্রাম দরকার। তাদের সেরে উঠার জন্য একটু সময় দরকার। এখনই আন্দোলনের সুর তুলে তাদের হৃদয়ে দোলা দেওয়ার কোনও মানে নেই। তারাও একটু সুখ চায়, একটু শান্তি ও স্বস্তি চায়!

শুধু বিএনপির নেতাকর্মীরাই নয়, আমরা দেশের নিরীহ মানুষেরাও একটু সুখ চাই, একটু অবসর চাই, একটু সুখে থাকতে চাই। এর মধ্যে কাউকে ভূতে কিলাক তা আমরা দেখতে চাই না। আমরা আসলে 'পোষা গরু', 'ভুষি' পেলেই খুশি হই, কিন্তু 'ঘুষি' খেলে বাঁচি না!

 

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।