আনসেন্সরড অ্যান্ড ডেসপারেট!

হারুন উর রশীদফেসবুকে একটি ক্লোজ গ্রুপের নাম ‘ডেসপারেটলি সিকিং আনসেন্সরড’ বা সংক্ষেপে ডিএসইউ। নামটি এখন বেশ আলোচনায়। এরকম নামে একটি নয়, অনেক গ্রুপ আছে। আর এই আনসেন্সরড গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে কিশার-কিশোরী, তরুণ-তরুণী সব পক্ষই আছে। আমি প্রথমে নাম শুনে ভেবেছিলাম, এরা মনে হয় বাক স্বাধীনতার কোনও গ্রুপ- যারা নিজেদের কথা তুলে ধরতে চায়। বলতে চায় স্বাধীনভাবে। আমার ধারণাটি একেবারে অমূলক নয়। তারা আনসেন্সরড হওয়ার জন্য ডেসপারেট, তবে তা অন্য বিষয়ে- অন্য ‘স্বাধীনতা’। কিন্তু এর আড়ালেও আছে এক কুৎসিত ও ভয়ঙ্কর ব্যবসা, যা এখনও অনেকে আঁচ করতে পারেননি।

ডেসপারেটলি সিকিং আনসেন্সরড গ্রুপ কী?

এই আনসেন্সরড গ্রুপের তিনজনকে আটক করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আরও অন্তত ১৬ তরুণ-তরুণীকে খুঁজছে, যারা এই ফেসবুক গ্রুপগুলোর এ্যাডমিন হিসেবে কাজ করছে। তাদের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। আর তাদের প্রত্যেকের একাধিক ফেসবুক আইডি আছে। অধিকাংশই অন্যের, বিশেষত মেয়েদের ছবি ব্যবহার করে আইডি খুলেছে।
এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তারা জানাচ্ছেন, ‘এই ক্লোজ গ্রুপগুলোতে মূলত অশ্লীল ভিডিও, স্থিরচিত্র ও উত্তেজক কথাবার্তা প্রকাশ করা হয়। তারা একে অন্যের সঙ্গে পর্নোগ্রাফির ভিডিও, স্থিরচিত্র শেয়ার করে। গ্রুপগুলো উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করতে নেয় নানা কৌশল।’
এখানেই শেষ নয়। এই গ্রুপের সদস্যরা অন্যদের, বিশেষ করে তরুণীদের ছবি সংগ্রহ করে ফেসবুক বা অন্যকোনও মাধ্যমে সেই ছবি ব্যবহার করে নিজেরা আইডি খোলে। আর সেই আইডি থেকে নানা অশ্লীল পোস্ট দেয়। আবার ছবি বিকৃত করেও তরুণীদের ব্ল্যাকমেইল করে। তরুণীদের ইনবক্সে পাঠায় নানা বার্তা এবং বিকৃত ছবি; যা দিয়ে তারা গ্রুপে টানে অথবা ভয় দেখিয়ে সুবিধা আদায় করে।

তারা কতটা ডেসপারেট এবং ভয়াবহ!

তিনজনকে আটকের পর ১৫ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, গ্রুপটির অ্যাডমিন ও তাদের সহযোগীরা ফেসবুক আইডি হ্যাকিং-এ জড়িত। তারা নারী মডেল, অভিনেতা ও কলেজ শিক্ষার্থীদের আইডি হ্যাক করে তাদের টাইমলাইনে পর্নোগ্রাফি দিয়ে সম্মানহানি করে। অর্থ আদায় করে।

এদের ব্ল্যাকমেইলের শিকার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এক নারী শিক্ষার্থী সম্প্রতি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। তারা প্রথমে ওই শিক্ষার্থীর আইডি হ্যাক করে ও একটি ব্যক্তিগত ভিডিও পোস্ট করে, যা পরবর্তীতে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে।

এখানে ওপরের তথ্যে পাঁচটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে

১. এরা নিজেরা এক ধরনের বিকৃত মানসিকতার অধিকারী।

২. এদের উদ্দেশ্য ব্ল্যাকমেইল, অর্থ অথবা অন্যকিছু আদায় করা।

৪. এরা পর্নোগ্রাফি তৈরি করে।

৩. এরা পর্নোগ্রাফি ছড়ায়।

৫. পর্নোগ্রাফির বাজার সৃষ্টি করে।

বিষয়টি আরও ভয়াবহ

‘ডেসপারেটলি সিকিং আনসেন্সরড’এর সদস্য এক লাখ ২২ হাজার বলে জানা গেছে। তিনজন অ্যাডমিন আটক হয়েছে। আর ১৬ জনকে অ্যাডমিন হিসেবে চিহ্নিত করে আটকের চেষ্টা করছে পুলিশ। তাহলে বাকি যে বিপুল সংখ্যক সদস্য, তাদের ভূমিকা কী?

আসলে এরা মেম্বার রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে সদস্য হয়েছে। আর এদের আকৃষ্ট করা হয়েছে নানা ধরনের বিকৃত ছবি, ভিডিও বা আলাপের মাধ্যমে। বলতে গেলে গুটিকয়েক ছাড়া আর সব কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী কৌতুহলবশত অথবা বিকৃতির আকর্ষণে এই ফেসবুক গ্রুপের সদস্য হয়েছে। কিন্তু তারা হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে জানতোই না যে, তারা আসলে এর গিনিপিগ। আসলে এই গ্রুপের সদস্য হয়ে যারা গোপন আলাপে ব্যস্ত হয়েছে, ব্যক্তিগত অনুভূতি, ছবি বা ভিডিও শেয়ার করেছে, তা  গ্রুপের অ্যাডমিনদের হাতে চলে গেছে। আর এগুলোই হয়েছে তাদের অস্ত্র। ভিডিও চ্যাটে যা করেছে তাও রেকর্ড করা হয়েছে। গ্রুপের অ্যাডমিনদের হাতে পুরোপরি জিম্মি হয়ে পড়েছে কেউ কেউ শুধু কৌতুহল মেটাতে গিয়ে বা নিষিদ্ধ আকর্ষণে।

এটা পর্নোগ্রাফিরও বড় মাধ্যম

এই গ্রুপগুলো যারা চালায় তারা ব্ল্যাকমেইল ছাড়াও পর্নোগ্রাফি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকে। অনলাইনে নানাভাবে কিশোর-কিশোরী বা উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের নানাভাবে আকৃষ্ট করে পর্নোগ্রাফি তৈরির চক্র সারা দুনিয়ায় সক্রিয়। আর এই পর্নো ছবি এবং ভিডিওর আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেট আছে দুনিয়া জুড়ে। এটা কোটি-কোটি ডলারের ব্যবসা। আমরা জানি না এরই মধ্যে এই গ্রুপের কত সদস্য এর শিকার হয়েছেন। কারণ যাকে নিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি হয়, সেটা হয়তো সে নাও জানতে পারে। বাংলাদেশের কোনও টিনএজকে নিয়ে করা পর্নো ভিডিও হয়তো বিক্রি হয়েছে ইউরোপের বাজারে।

যাদের সঙ্গে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। প্রতারণা করে অর্থ আদায় করা হয়েছে, তারাই হয়তো তাদের বিষয়টি জানতে পেরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গেছেন। কিন্তু যাদের বিষয় এখনও প্রকাশ হয়নি অথবা যাদের নিয়ে এখনও ব্যবসা হয়নি তারা কিভাবে জানবেন।

পর্নোগ্রাফির খতিয়ান

বিশ্বে পর্নোগ্রাফি এখন একটি বড় ব্যবসা। ২০০৭ সালে পর্নোগ্রাফি ব্যবসায় ২০ বিলিয়ন ডলার নিট লাভের হিসাব দিচ্ছে পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত মাকের্ট রিচার্স গ্রুপগুলো। আর এই ব্যবসা দিনদিন বাড়ছে।  ২০১৭ সালে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিট ব্যবসার আভাস দিচ্ছে বিজনেজ ইনসাইডার। বলা হচ্ছে, গত ১৭ বছরে এটাই হবে সর্বোচ্চ ব্যবসা। এই পর্নোগ্রাফি প্রোডাক্ট-এর শিকার ও টার্গেট- উভয়ই টিনএজরা।

মার্কেট প্লেস হিসেবে দিনদিন অনলাইন পর্নোগ্রাফির গ্রাহক বাড়ছে। বিজনেস ইনসাইডার জানায়, এখন ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ট্যাব সবখানেই পর্নোগ্রাফির অনুপ্রবেশ। বিশ্বে পর্নো ওয়েবসাইট ২৫ মিলিয়ন  এবং এই সাইটগুলো মোট ওয়েব ট্রাফিক-এর ৩০ ভাগ টানছে।

ফেসবুকের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি

২০১৪ সালের এপ্রিলে নিউজিল্যান্ডে ড্যানিয়েল জোনস নামে ২৪ বছরের এক তরুণকে আটক করা হয় ফেসবুক পর্নোগ্রাফির দায়ে। সে ফেসবুকে কিশোরীদের প্রলুব্ধ করে পর্নোগ্রাফি তৈরি করতো। পুলিশ তাকে আটকের পর তার কাছ থেকে একাধিক কিশোরীর পর্নোগ্রাফির ভিডিও উদ্ধার করে। সে ফেসবুকে মায়েদের সঙ্গে চ্যাট করে তাদের কিশোরী সন্তানদের সঙ্গে পরিচিত হতো। নানা উপায়ে ছবি বিনিময় করতো। ভিডিও করতো। আর এটা সে করতো শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির জন্য।

আর অস্ট্রেলিয়ার হেরাল্ড সান ২০১১ সালে এক গবেষণার বরাত দিয়ে জানায়, ‘ফেসবুক ও টুইটারে আইডি খুলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে পর্নোগ্রাফি ছড়ানো হয়। জরিপের নামে ওই পর্নোগ্রাফি ছড়ানো হয় বেশি।’ তাই ভিক্টোরিয়া পুলিশ তখন এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। পর্নোগ্রাফি ছড়ানোর উদ্দেশ্য ছিলো তাদের আকৃষ্ট করা এবং এর বাজার সৃষ্টি করা।

তাই বাংলাদেশের এই গ্রুপগুলো যে শুধু পর্নোগ্রাফি তৈরির উদ্দেশ্যে হয়েছে তাই নয়। তারা পর্নোগ্রাফির গ্রাহক এবং বাজারও তৈরি করে ব্যবসার জন্য।

ঢাকার শিশু পর্নো ছবির চাহিদা  ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে

২০১৪ সালে শিশুসাহিত্যিক টিপু কিবরিয়াকে আটক করে সিআইডি। তিনি ৯ বছর ধরে মুগদাপাড়ায় একটি স্টুডিও বানিয়ে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি করে আসছিলেন বলে তখন আদালতে স্বীকার করেন।

তিনি তার আরও তিন সহযোগীকে নিয়ে পথশিশুদের সহায়তার নামে স্টুডিওতে এনে পর্নো ছবি  তৈরি করে ইন্টারনেটে পে-ওয়েবসাইটে বিক্রি করতেন। জার্মানি, সুইজারল্যান্ডে সরাসরি পাঠাতেন চুক্তিতে। আর ঢাকায় ১৩টি দেশের নাগরিকরা সরাসরি তার শিশু পর্নো ছবির গ্রাহক ছিলেন। তারা কানাডা, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, মধ্য ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের নাগরিক।

একটি ফটোগ্রাফি সোসাইটি গড়ে তুলে তার ছায়ায় আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত এই কুৎসিত ব্যবসা চালিয়ে যান টিপু কিবরিয়া। মাসে আয় ছিলো ১০ লাখ টাকারও বেশি।

বিপদ আরও বড়

২০১০ সালে সিডনিতে ফেসবুকে ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয় ১৮ বছরের তরুণী নোনা বালামেসোফাকে। ক্রিস্টোফর জেমস নামে একজন পশুপ্রেমী সেজে ভুয়া ফেসবুক আইডি খোলে। এরপর আহত পশু উদ্ধারে যাওয়ার কথা বলে তাকে ফেসবুকে মেসেজ দেয়। কিন্তু যাওয়ার পর তাকে অপহরণ ও হত্যা করে। দু’দিন পর নোনার লাশ পাওয়া যায়। নোনাও একজন পশুপ্রেমী ছিলেন। তাকে অপহরণের পর ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায় ক্রিস্টোফার। আর এই ঘটনা ‘ফেসবুক মার্ডার’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

একই বছর যুক্তরাজ্যে পিটার চ্যাম্পম্যান ফেসবুকে ফাঁদ পেতে হাসিফর হল নামে ১৭ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণ এবং হত্যা করে। ৩৩ বছর বয়সী চ্যাম্পম্যান একজন ভালো বাবা সেজে তাকে ফাঁদে ফেলেছিল।

আমাদের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীদের বুঝতে হবে কৌতূহলী হয়ে এ ধরনের ফেসবুক বা অনলাইন গ্রুপে যোগ দেওয়ায় কী বিপদ হতে পারে। আর গ্রুপে নিজের ব্যক্তিগত বা গোপনীয় ছবি বা ভিডিও শেয়ার করলে তার পরিণতি কী হতে পারে। চ্যাট করতে করতে বন্ধু ভেবে একান্তে দেখা করার প্রবণতা আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। আবার নিজেই অপরাধীদের দলে ভিড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

আর অভিভাবকদেরও জানতে হবে। জানাতে হবে সন্তানকে। তাদের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করে এর বিপদ সম্পর্কে বোঝাতে হবে। বন্ধু নির্বাচনের মতই ফেসবুক-বন্ধু নির্বাচনেও যে সতর্ক থাকতে হয়, তা তাদের যুক্তি ও তথ্য দিয়ে স্পষ্ট করতে হবে। কারণ এই প্রজন্ম মনে করতেই পারে, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রযুক্তি বেশি বোঝে।

নেপথ্যে বড় বিনিয়োগকারী

এইসব ফেসবুক বা অনলাইন গ্রুপ দেখে মনে হতে পারে নিরীহ, ফান করার জন্য। কিন্ত আসলে তা নয়। এর কোনওটির  পেছনে আছে বড় কোনও পর্নোগ্রাফি র‌্যাকেটের বড় বিনিয়োগ। তাদের হয়ে কাজ করার জন্য আছে বেতনভুক্ত লোক। আর তারাই প্রলুব্ধ করে, হাতছানি দেয়, ফাঁদে আটকে ফেলে।

বাংলাদেশের ‘ডেসপারেটলি সিকিং আনসেন্সরড’ গ্রুপের মূল অ্যাডমিন রাউল চৌধুরী দেশের বাইরে। সে মালয়েশিয়ায় পালিয়ে গেছে। কিন্তু আমি মনে করি, রাউল আমাদের কাছে দৃশ্যমান। এর পেছনে আরও বড় গ্রুপ জড়িত, যারা সরাসরি আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ ঠিকমতো তদন্ত করলে তা বেরিয়ে আসবে বলে আমি মনে করি।

লেখকঃ সাংবাদিক

swapansg@yahoo.com