ক্যাশ জার্নালিজম

হারুন উর রশীদময়মনসিংহে দু’জন সাংবাদিক অস্ত্র এবং অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ আটক হয়েছেন রবিবার। তাদের একজন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং আরেকজন রিপোর্টার। খবরটির কাছে এখন পুলিশের গ্রেফতারের নামে চাঁদাবাজির খবরও যেম ম্রিয়মান হয়ে গেছে। কারণ সাংবাদিকতায় রিপোর্ট প্রকাশের হুমকি দিয়ে অথবা রিপোর্ট প্রকাশ করে অর্থ আদায়ের কথা আমরা জানতাম। আর এবার দেখছি সরাসরি অপরাধেই জড়িয়ে পড়েছেন এই দু’জন।
অস্ত্রসহ আটক শেখ মেহেদী হাসান ওরফে নাদিম ময়মনসিংহের সংবাদপত্র দৈনিক জাহানের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং মো. রাসেল মিয়া ওই পত্রিকায় সাংবাদিক। আর এ পর্যন্ত যা জানা গেছে তার সারকথা হলো তারা অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত দীর্ঘদিন ধরে। তাদের যে বাড়ি থেকে আটক করা হয়েছে সেই বাড়ির একাংশে তারা তাদের অবৈধ অস্ত্র কারখানা গড়ে তুলেছিলেন।
অস্ত্রের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। গত ১৪ ডিসেম্বর কক্সবাজারে ৪০ হাজার অবৈধ মাদক ইয়াবাসহ আটক হন বেসরকারি টেলিভিশন গাজী টিভির জেলা প্রতিনিধি মোহাম্মদ সেলিম ও তার স্ত্রী মুন্নি আক্তার। সেলিম একইসঙ্গে কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত দৈনিক কক্সবাজার বার্তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ।
এ ধরনের ঘটনার নজির যে রাজধানীতে নেই তা কিন্তু নয়। ঢাকার একটি প্রভাবশালী দৈনিকের একজন রিপোর্টারের সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা হয়তো অনেক সাংবাদিকেরই মনে আছে। ঘটনাটি প্রায় একযুগ আগের। সেই পত্রিকাটি তখন তাকে চাকরি থেকে বিদায় করে তাদের নিজেদের মানসম্মান বাঁচায়। আর সাংবাদিক মামলা খেয়ে কয়েকবছর চুপচাপ থেকে এখন বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। আরেকজন টেলিভিশন সাংবাদিক এমএলএম ব্যবসার নামে প্রতারণা করে সাধারণ মানুষের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সস্ত্রীক কারাগারে গিয়েছিলেন। তিনিও ছাড়া পেয়ে এখন দেশের বাইরে।

চাইলে এই উদাহরণ আরও বাড়ান যাবে। তা না বাড়িয়ে বলে রাখি ঢাকায় এখন কিছু সাংবাদিকের সিন্ডিকেট ব্যবসা জমজমাট। তারা দলবদ্ধভাবে প্রতিবেদন করার নামে টাকা আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।  আর এই অভিযোগে একজন টেলিভিশন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানের স্বয়ং চেয়ারম্যান। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর সেই সাংবাদিক হাত-পা ধরে বেঁচে যান। আর ঘুষের তিন লাখ টাকায় কম্বল কিনে দেন চেয়ারম্যানকে। যা চেয়ারম্যান সাহেব শীতে ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করেন।

কিছু সাংবাদিকের এই অধঃপতন কেন? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছি বার বার। আর প্রথম যে জবাবটি পেয়েছি তা হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। সংবাদমাধ্যমের কে মালিক হতে পারবেন, কে সম্পাদক হতে পারবেন সেই বিষয়টি এখনও নির্দিষ্ট নয়। তাই টাকা থাকলে মালিক বা সম্পাদক হওয়া যায় এটা বাজারে প্রতিষ্ঠিত ধারণা। বাস্তবেও তাই। ফলে মালিকদের একাংশের উদ্দেশ্যই থাকে সংবাদমাধ্যমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বৈধ-অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া। আর তারা যাদের সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দেন তাদের একটি অংশ তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য কাজ করেন। ফলে মালিক সাংবাদিক দুই-এ মিলে হয়ে যায় এক সিন্ডিকেট। যেমন ময়মনসিংহে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং রিপোর্টার মিলে হয়ে উঠেছেন অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী।

সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার এই অধঃপতনের খবর যে শুধু বাংলাদেশে তা নয়। এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এর কালো থাবা ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপ এবং আমেরিকাও এ থেকে মুক্ত নয়।

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকার প্রভাবশালী অনলাইন হাফিংটন পোস্ট-এ সাংবাদিক অ্যাডম বেমা এক প্রতিবদেনে আফ্রিকায় সাংবাদিকদের  দুর্নীতির কথা তুলে ধরেন। তিনি তার প্রতিবেদনে বলেন আফ্রিকায় টাকা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ একটি সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। অনেক সাংবাদিক, তবে সবাই নয় পরিবহন খরচ অথবা চুক্তিকে অর্থ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন। আর সেন্টার ফর মিডিয়া অ্যাসিসট্যান্স ২০১০ সালে প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন লেখক এবং গবেষক বিল রিসটো’র প্রতিবেদন "Cash for Coverage: Bribery of Journalists Around the World".

আর এই গবেষণা প্রতিবেদনে তিনি তুলে বিশ্বে সাংবাদিকদের একাংশ কীভাবে আর্থিক চুক্তি, মিথ্যা অভিযোগ, প্রমোশনাল নিউজ, রাজনীতিবিদদের কাভারেজ, নির্বাচনের কাভারেজ দিয়ে অর্থ আদায় করেন। আর এরসঙ্গে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংবাদমাধ্যমও যে জড়িত তাও প্রকাশ পায় গবেষণায়। তখন ক্যাশ জার্নালিজম-এর তালিকায় চীনের অবস্থা বেশ খারাপভাবেই দেখানো হয়।

গবেষণায় নাম প্রকাশ না করে অংশ নেওয়া কম্বোডিয়ার সাংবাদিকদের ২৫ ভাগ জানান, ‘সাংবাদিকরা অর্থের বিনিময়ে রিপোর্ট করেন’। আর ৩৫ ভাগ জানান, ‘তাদের সহকর্মীরা খবর প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ নিয়ে থাকেন’। অন্যদিকে শতকরা ১৩ জন সাংবাদিক সরাসরি সরাসরি ঘুষ নেওয়ার কথাও স্বীকার করেন।

আর ক্যাশ জার্নালিজমে অভ্যস্ত কিছু সংবাদমাধ্যমের কোপানলে পড়েছেন সৎ সাংবাদিকরা। যেমন ফক্স নিউজের জেন অ্যাক্রি, সিবিএস নিউজের ড্যান রথার প্রমূখ।

বাংলাদেশেও সৎ সাংবাদিকতার পীড়ন আছে। চাকরি হারানোর ভয় আছে। আর কোনও কোনও প্রতিষ্ঠানে ক্যাশ জার্নালিস্টদের আধিপত্যে সৎ সাংবাদিকদের কোণঠাসা অবস্থা। আর এই ক্যাশ জানার্লিস্টরা এতই প্রভাবশালী যে তারা রাতকে দিন করতে সক্ষম। মালিকদের একাংশ এই ক্যাশ জার্নালিস্টদের পোষেন। কারণ তারও মিডিয়ার মাধ্যমে ক্যাশ পকেটে ভরেন।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্ব পরিস্থিতির চেয়ে একটু খারাপই মনে হয়। কারণ বাইরের বিশ্বে সাংবাদিকদের যে অসততা চোখে পড়ে তা হলো সাংবাদিকতার মাধ্যমে, সাংবাদিকতা করে। আর বাংলাদেশের যে দু’টি ঘটনার উদাহরণ আমি প্রথমেই দিয়েছি তারা সরাসরি অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। সাংবাদিকতার আড়ালে তারা অপরাধ সিন্ডিকেটের সদস্য। এটা আরও বেশি ভয় এবং আতঙ্কের। কারণ এই পেশাকে এখন অপরাধীরা ব্যবহার করছে।

আমার ধারণা বাংলাদেশে ক্যাশ জার্নালিজম নিয়ে গবেষণা হলে অনেক গোমর ফাঁস হবে। আমরা হয়তো অনেক প্রভাবশালী সাংবাদিকের আসল পরিচয় জানতে পারব। তিন বছর আগে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানকে এই প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমি। তিনি রাজিও হয়েছিলেন এটা নিয়ে কাজ করতে। কিন্তু তিন বছরেও তা শুরু হয়নি। আদৌ হবে কি?

লেখক : সাংবাদিক

ইমেইল:swapansg@yahoo.com