রাঙ্গুনিয়ায় বসতভিটা হারানোর শঙ্কায় অর্ধ-শতাধিক পরিবার

ইছাখালীর ভাঙনে হুমকিতে থাকা বসতভিটা (ছবি- চট্টগ্রাম প্রতিনিধি)

‘বসতঘরের জায়গাটুকুই ছিল মাথা গোঁজার একমাত্র ঠিকানা। খালের ভাঙনে তাও হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমরা যাব কোথায়! থাকব কই!’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ইছাখালী খালের ভাঙনে শেষ আশ্রয়টুকু হারানো সুলতানপুর এলাকার বাসিন্দা আজম খান।

সোমবারের (১৩ জুন) পাহাড়ি ঢলে ইছাখালী খালের ভাঙনে বসতঘর হারিয়েছেন তিনি। শুধু আজম খান নয়, ওই সময় পানির তীব্র ঢলে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সুলতানপুরের আরও তিন-চারটি ঘর খালে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় অর্ধ-শতাধিক পরিবার আশঙ্কা করছে, পাহাড়ের ঢল আর ভারি বর্ষণের কবলে পড়ে খালে বিলীন হওয়া থেকে তাদের বসতভিটাও আর বাঁচানো যাবে না।

আজম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টানা বৃষ্টিতে ওই সময় আমার ঘরের মধ্যে হাঁটু পরিমাণ পানি জমে যায়। পরে আবদ্ধ পানি নামতে শুরু করলে শুরু হয় খালে ভাঙন। শুরুতে তীব্র স্রোতে খালের পাড়ে ঘরের যে অংশ ছিল, তা ধসে পড়ে। পরে দুই দিনের মধ্যে পুরো ঘর খালে বিলীন হয়ে যায়।’

সুলতানপুরের বাসিন্দা ও স্থানীয় কৃষকলীগের ৪নং ওয়ার্ডের সভাপতি ইদ্রিস আলম সর্দার জানান, ভাঙনে তার ঘরও বিলীন হয়ে গেছে। অন্যদের মতো তিনিও এখন ছেলেমেয়ে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন।

ইছাখালীর ভাঙনে হুমকিতে থাকা বসতভিটা (ছবি- চট্টগ্রাম প্রতিনিধি)

ইদ্রিস আলম নামে আরেকজন বলেন, ‘সুলতানপুরে ৫০টিরও বেশি পরিবারের বাস। পাহাড়ি ঢলে ইছাখালি খালে ভাঙনে আমার ঘরসহ আরও চার-পাঁচটি পরিবারের ঘর খালে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতিদিনই এ এলাকার কিছু অংশ খালে ভেঙে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে অন্য ঘরগুলোও খালে বিলীন হয়ে যাবে।’

বঙ্গোপসাগরে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে নিম্নচাপ তৈরি হলে গত সোমবার থেকে টানা বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এতে রাঙ্গুনিয়াসহ পাবর্ত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি পানিবন্দি হয়ে পড়েন রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের বাসিন্দারা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ওই সময় রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড়ের মাটিচাপা পড়ে ও পাহাড়ি ঢলে ভেসে গিয়ে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ৬২ জন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৬৭৫টি পরিবার। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুলতানপুর এলাকার মানুষ।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢলে এই এলাকার অধিকাংশ ঘরে হাঁটু পরিমাণ পানি জমে যায়। এভাবে পানিবন্দি অবস্থায় তিন দিন ছিলেন তারা। ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় অধিকাংশ বসতঘর। খালের ভাঙনে বিলীন হয়ে যায় কয়েকটি ঘরবাড়ি। বসতবাড়ি খালে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় এখনও দিন কাটাচ্ছে সেখানকার অর্ধ-শতাধিক পরিবার।

ভাঙছে ইছাখালীর পাড়, বসতভিটা হারানোর শঙ্কা বাড়ছে স্থানীয়দের (ছবি- চট্টগ্রাম প্রতিনিধি)

শনিবার (১৭ জুন) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঝড়ো বাতাসে ভেঙে যাওয়া ঘরগুলো এখনও ওই অবস্থায় পড়ে আছে। ঘরের বাসিন্দারা ভাঙাচোরা বিভিন্ন জিনিসপত্র ধ্বংসস্তুপ থেকে আলাদ করছেন। কেউ ব্যস্ত ঘরের চাল ঠিক করতে, কেউ ছোটখাটো জিনিসপত্র আলাদা করে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করতে।

ইছাখালী খালের পূর্ব পাশ থেকে নৌকাযোগে পশ্চিম পাড়ের এই পাড়ায় যেতে চোখে পড়ে খালে ভেঙে পড়া অংশ। বড় বড় মাটির টুকরোসহ খালের মধ্যে উপড়ে পড়ে আছে গাছপালা।

ঝড়ে উড়ে যাওয়া ঘরের চাল মেরামত করছিলেন রেজাউল করিম। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘টানা বৃষ্টির সময় ঝড়ো বাতাসে আমার ঘরের চাল উড়ে যায়। এলাকার মসজিদের সঙ্গেই ছিল আমার দোকান। সেটাও ঝড়ে উড়ে যায়।’

পঞ্চাশ বছর বয়সী রেজাউল আরও বলেন, ‘আমার জীবদ্দশায় এমন ভাঙন কখনও দেখিনি।  ভাঙন শুরু হয়েছে তাতে শিগগিরই এই পাড়ার ঘরবাড়িগুলো খালে বিলীন হয়ে যেতে পারে।’

রাজানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামশুল আলম তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি সরেজমিনে গিয়ে ওই এলাকা পরিদর্শন করেছি। দুয়েকটি ঘর খালে বিলীন হয়ে গেছে। বেশ কিছু ঘরবাড়ি হুমকির মুখে পড়েছে। ওই ঘরগুলো সেখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে।’

অতি বৃষ্টিতে ঢল নামলে তীব্র স্রোতে পাড় ভাঙে ইছাখালীর (ছবি- চট্টগ্রাম প্রতিনিধি)

ইউপি চেয়ারম্যান সামশুল আরও বলেন, ‘এসব পরিবার হুমকির মুখে রয়েছে। তাদের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। উনারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।’

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ‘যাদের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, আমরা তাদের তালিকা তৈরি করেছি। তাদের নতুন ঘর বানানোর জন্য টিন ও নগদ পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এখনও সরকারি বরাদ্দ আসেনি, এলেই তাদের হাতে তা তুলে দেবো।’

ইউএনও আরও বলেন, ‘সুলতানপুর এলাকায় ভাঙনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে ত্রাণ ও পুর্নবাসন মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা সতা বাস্তবায়ন করব।’

/এমএ/টিআর/