মাইদুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলে, ‘মিয়ানমারের সেনারা আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর আমরা (সে এবং তার মা-বোন) পালিয়ে উখিয়ায় চলে আসি। সেখানে কিছুদিন থাকার পর আমরা চট্টগ্রাম শহরে চলে আসি। এখন আউটার স্টেডিয়াম এলাকায় থাকছি।’
শুধু মাইদুল হাসান নয়, গত কয়েকদিন ধরে কাজির দেউরি এলাকায় তার মতো আরও কয়েকজন শিশুকে ভিক্ষা করতে দেখা যায়, যাদের বাড়ি মিয়ানমারে। সহিংসতায় ভিটে-মাটি হারিয়ে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তারা। পরে শরণার্থী ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে নগরীর আউটার স্টেডিয়ামসহ আশপাশের বিভিন্ন বস্তিতে তারা পরিবারের সঙ্গে থাকছে। চট্টগ্রামের স্থানীয় মানুষের সঙ্গে ভাষা ও শারীরিক গঠনগত মিল থাকায় তারা খুব অল্প সময়ে নগরবাসীর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তাদের অনেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে চাকরি নিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। আর যারা খুব অসহায় তারা নগরীতে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। তবে পুলিশের দাবি, নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী কোনও রোহিঙ্গা চট্টগ্রামে প্রবেশ করেনি।
জানা গেছে, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা শুধু ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়েছেন তা নয়, অনেক রোহিঙ্গা স্বল্প খরচে বাসা ভাড়া নিয়ে নগরীতে থাকছেন। তৈরি পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিও নিচ্ছেন।
বেসরকারি সংগঠন ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইফসা) সাবেক প্রোগ্রাম ম্যানেজার সিরাজ উদ্দিন বেলাল নিরাপদ অভিবাসন ও মানবপাচার প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করতেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আপনি যদি পটুয়াখালী যান সেখানেও রোহিঙ্গা পাবেন। রোহিঙ্গারা ভাষাগত ও শারীরিক গঠনে দেখতে চট্টগ্রামের মানুষের মতোই। তাই তাদের খুব সহজে চিহ্নিত করা যায় না। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় চট্টগ্রামের মানুষ বলে পরিচয় দিয়ে চাকরি নিচ্ছে। ওইসব এলাকায় বসতি স্থাপন করছে। এটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকির কারণ হবে।’
সিরাজ উদ্দিন বেলাল আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের তালিকা নির্ধারণ করা উচিত। তাদের যদি উদ্বাস্তু হিসেবে পরিচয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তাহলে অন্য এলাকার লোকজন সহজে তাদের চিহ্নিত করতে পারবে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে তাদের ফেরত পাঠাতে গেলেও তখন সরকারকে ঝামেলায় পড়তে হবে না।’
তিনি দাবি করেন, ‘একটা সময় বাংলাদেশে প্রায় তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা ছিল। এখন আপনি খোঁজ নেন ওই রোহিঙ্গারা আর নেই। তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বসবাস করছে।’
রোহিঙ্গারা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরীতে নতুন করে কোনও রোহিঙ্গার প্রবেশ ঘটেনি। যারা এখন নগরীতে থাকছেন তারা অনেক আগে নগরীতে এসেছেন। ভাষাগত মিল থাকায় তাদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা যাতে চট্টগ্রাম জেলার কোনও স্থানে বসতি গড়ে তুলতে না পারে, সেজন্য আমরা কঠোর নজরদারি রাখছি। ইউনিয়ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের আমরা নির্দেশনা দিয়েছি, যদি অপরিচিত কোনও ব্যক্তি তার এলাকায় বসতি স্থাপন করে, সঙ্গে সঙ্গে যেন পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ কয়েকজন রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সাম্প্রতিক সংহিসতার ঘটনায় তারা ছাড়া বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কেউ এখনও চট্টগ্রাম জেলায় প্রবেশ করেনি। সামনে প্রবেশ করার সুযোগ নেই।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের অপরাধে জড়ানোর মতো অবস্থা এখনও তৈরি হয়নি। তারা এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। কিন্তু এর আগে যারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন, তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।’
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) মাসুদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সদ্য অনুপ্রবেশকারীরা রোহিঙ্গারা চট্টগ্রাম নগরীতে ছড়িয়ে পড়ছে এমন কোনও তথ্য আমাদের কাছে নেই। রোহিঙ্গারা যেন নগরীতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য আমরা কঠোর নজরদারি রাখছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমারের নাগরিকদের ধর্ম-বর্ণ সবকিছুই বাংলাদেশের নাগরিকের মতো। তাই সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া তাদের পার্থক্য করা অত্যন্ত কঠিন। এ কারণে বিভিন্ন স্থানে চেক পোস্ট থাকলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিচ্ছেন তারা।’
নগর পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশসহ বিভিন্ন বিষয়ে এই কমিটি কাজ করবে।’
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে কোনও রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কোনও তথ্য আমরা পাইনি। তবে এর আগে ইয়াবা পাচার, চুরি-ডাকাতির ঘটনায় আমরা কয়েকজন রোহিঙ্গাকে আটক করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ওপর আমাদের নজরদারি রয়েছে। কয়েকদিন আগেও কক্সবাজার থেকে পালিয়ে নগরীতে আসার সময় আমরা তাদের ধরে বিজিবি'র কাছে হস্তান্তর করেছি।'
আরও পড়ুন:
পাহাড়ের চূড়ায় প্রথম সন্তানের মা হলেন রোহিঙ্গা নূর বিবি