লাইসেন্স নিয়ে বিভ্রান্তিতে চাল ব্যবসায়ীরা

 

রাজশাহীর একটি চালের দোকানআমদানিকারক থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়ের চাল বিক্রেতার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করার বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। আমদানিকারক, মজুদদার, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করায় জটিলতা ও খরচ বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে চালের বাজারে। ‘ফুড লাইসেন্স’ ও ‘ট্রেড লাইসেন্স’ থাকার পরও চাল বিক্রির জন্য পৃথক লাইসেন্স কেন নিতে হবে, এই নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলছেন। আবার ভিন্নমতও পোষণ করেছেন কেউ কেউ। তাদের মতে,  এতে চালের অবৈধ মজুদ বন্ধ হবে। দেশের চাল আমদানিকারক, মজুদদার, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে তারা এমন মত প্রকাশ করেছেন।

রাজশাহী

রাজশাহীর চাল ব্যবসায়ীরা লাইসেন্স নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে মিল মালিকদের ধান মজুদ রাখার দিকে প্রশাসনের নজরদারিরও দাবি জানিয়েছেন তারা।

লাইসেন্স নেওয়ার ব্যাপারে জেলার কাদিরগঞ্জ পাইকারি চাল ব্যবসায়ী আড়ৎ সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক বজলুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এরশাদের আমলে চাল ব্যবসায়ীদের জন্য লাইসেন্সের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তা বাতিল করে দেওয়া হয়। খাদ্যমন্ত্রী আবার নতুন করে লাইসেন্স নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তার বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই লাইসেন্স নেব। আগামী মাস থেকে রির্টান দাখিল করব। এছাড়া আমরা ট্রেড লাইসেন্স, সিটি করপোরেশনের ক্লিনিং লাইসেন্স, লেবার ইনস্পেক্টর, ইনকাম ট্যাক্স ফাইল, চেম্বার অব কর্মাসের সদস্যপদ—এসব কিছু করে রেখেছি। এখন কেবল খাদ্য অধিদফতর থেকে লাইসেন্স নেব। বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচকভাবেই নিয়েছি।’

হিলি

লাইসেন্স নেওয়ার নির্দেশের ব্যাপারে হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারকদের মতে, এতে জটিলতা বাড়বে। একইসঙ্গে খরচও বাড়বে। আর এর প্রভাব পড়বে বাজারে। তবে এতে অবৈধ মজুদ বন্ধ হবে বলেও মনে করছেন তারা।

হিলি স্থলবন্দরের চাল আমদানিকারক মামনুর রশীদ লেবু ও হারুন উর রশীদ হারুন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘এ নির্দেশের ফলে চাল আমদানির ক্ষেত্রে জটিলতা বাড়বে। বাড়বে খরচও।’ তাদের ভাষ্য, তারা লাইসেন্স নিয়েই মূলত পণ্য আমদানি করেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট পণ্যের আইপি (ইমপোর্ট পারমিট) ও আমদানি-রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর কাছ থেকে লাইসেন্স (আইআরসি) নিয়েই তাদের পণ্য আমদানি করতে হয়। এছাড়া তারা কী পণ্য  কী পরিমাণ পণ্য আমদানি  করছেন, তারও হিসাব রয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোয়। এরপরও তাদের যদি লাইসেন্স নিতে হয়, তবে খরচ বাড়ার পাশাপাশি তারা হয়রানির শিকার হবেন।

এ প্রসঙ্গে হিলি স্থলবন্দরের চাল আমদানিকারক ললিত কেশেরা বলেন, ‘সরকার চাল আমদানির ক্ষেত্রে ফুড লাইসেন্স করার কথা হয়েছে। এ সংক্রান্ত লাইসেন্স আমরা আগে থেকেই করে রেখেছি। বন্দরের আরও কয়েকজনের এ ধরনের লাইসেন্স করা রয়েছে। তবে অনেক আমদানিকারকের লাইসেন্স নেই।’

খুলনা

আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে লাইসেন্স নেওয়ার নির্দেশের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা নেই খুলনার চাল ব্যবসায়ীদের। নতুন করে কী ধরনের লাইসেন্স করতে হবে, এ নিয়ে তারা বিভ্রান্তিতে রয়েছেন। লাইসেন্স সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট তথ্য জানতে চান তারা। একইসঙ্গে চাল মজুদের তথ্য নিয়মিতভাবে জমা দেওয়ার জন্য খাদ্য বিভাগের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি নির্ধারণ ও মনিটরিং করা প্রয়োজন বলেও তারা মনে করেন।

খুলনার বড় বাজারে চালের পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স মুরাদ ট্রেডার্সের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্স আছে, কৃষি বিপণন লাইসেন্স আছে, টিন সার্টিফিকেট আছে। আবার কী লাইসেন্স করতে হবে, সেটা তো স্পষ্ট করতে হবে। আর যে লাইসেন্সই হোক না কেন, সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের কোনও মত-বিরোধ নেই। আমরা তা নেব। কিন্তু এ লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া যেন সহজ হয়। বিভিন্ন সময় লাইসেন্স পাওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তিতে পড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এক্ষেত্রে যেন সে ধরনের ভোগান্তি না থাকে, সে বিষয়টিকে অবশ্যই প্রধান্য দিতে হবে।’

মুন্সীগঞ্জ

খুলনার ব্যবসায়ীদের মতো মুন্সীগঞ্জের ব্যবসায়ীরাও লাইসেন্স নেওয়ায় ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে রয়েছেন। ব্যবসা করার জন্য তাদের ‘ফুড লাইসেন্স’ ও ‘ট্রেড লাইসেন্স’ থাকার পরও কেন আবার লাইসেন্স নিতে হবে, এ বিষয়টি তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আবার এ জেলার অনেক ব্যবসায়ী লাইসেন্স নেওয়ার বিষয়টি এখনও জানেন না বলেও জানিয়েছেন।

মুন্সীগঞ্জ বাজারের খুচরা চাল ব্যবসায়ী মো. নিজামউদ্দিনের প্রশ্ন, ‘আমাদের ‘ফুড লাইসেন্স’ ও ‘ট্রেড লাইসেন্স’ নেওয়া আছে। আবার লাইসেন্স লাগবে কেন?’ আরেক খুচরা চাল ব্যবসায়ী মো. মনির উদ্দিন বলেন, ‘লাইসেন্স আমাদের আগে থেকেই আছে। নতুন করে করা লাগবে কিনা, তা খোঁজ নিয়ে জানতে হবে। তবে অনেক মুদি দোকানেও চাল বিক্রি হয়। ওদের বোধ হয় লাইসেন্স নেই।’

মুন্সীরহাটের চাল ব্যবসায়ী পাপ্পু সাহা জানান, শুধু চালের ব্যবসার জন্য তাদের আলাদা কোনও লাইসেন্স নেই। তবে ফুড লাইসেন্স রয়েছে। মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুরের পাইকারী ব্যবসায়ীরা জানান, অনেক আগে থেকেই তাদের ফুড লাইসেন্স ও ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে। একই কথা জানান হক রাইস ট্রেডার্সের মালিক আয়নাল হক, আলাউদ্দিন অটোরাইস মিল মালিক কবীর হোসেন।

রংপুর

লাইসেন্স নেওয়ার নির্দেশ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রংপুরের খুচরা ও পাইকারী চাল ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে, খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা কোনও অবস্থাতেই লাইসেন্স নিতে রাজি নন। তাদের ওপর জুলুম করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা। এ সিদ্ধান্ত আড়তদার ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের বেলায় প্রয়োগ করার দাবি জানান তারা।

দিনাজপুর

লাইসেন্স নেওয়ার নির্দেশের ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দিনাজপুরের চাল ব্যবসায়ীরা। মিল মালিক ও আমদানিকারকরা এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেও খুচরা ব্যবসায়ীরা লাইসেন্স প্রক্রিয়া চালুর আগে নির্দেশনা চেয়েছেন।

সুনামগঞ্জ

লাইসেন্স নেওয়ার নির্দেশের পর অনেকটা যেন বিপাকে পড়েছেন সুনামগঞ্জের চাল ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, দুই দফা বন্যায় ধান তলিয়ে যাওয়ায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কোনও চাল নেই বাজারে। শুধু আমদানি করা চালের ওপর নির্ভর করেই তারা ব্যবসা করে আসছেন। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, প্রশাসনের চাপের মুখে তারা লাইসেন্স নিতে বাধ্য হলেও এর প্রভাব পড়বে স্থানীয় ক্রেতাদের ওপর।

উল্লেখ্য, চালের দাম সহনীয় করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত ২ অক্টোবর খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম চালের আমদানিকারক, মজুতদার, আড়তদার এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের খাদ্য অধিদফতর থেকে আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে লাইসেন্স নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া ১৫ দিন পর পর ব্যবসায়ীদের গুদামে মজুত করা চাল ও গমের হিসাব স্থানীয় খাদ্য দফতরকে অবহিত করারও নির্দেশ দেন মন্ত্রী।