পাহাড়ের বাতিঘর পাড়া কেন্দ্র

পাড়া কেন্দ্রে পড়ালেখা করছে শিশুরাপাহাড়ি দুর্গম জনপদগুলোয় রাষ্ট্রের মৌলিক সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো শুধু কঠিনই নয়, অনেক সময় প্রায় অসম্ভবও। প্রত্যন্ত এলাকার প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলোর জন্য স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা; শিক্ষা, বিশেষত নারী শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা বিবেচনায় তিন পার্বত্য জেলার অবস্থান নিচের দিকে। এ কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ যৌথভাবে পাড়া কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এরই মধ্যে পাহাড়ের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে পাড়া কেন্দ্রগুলো।
পাড়া কেন্দ্রগুলোকে এক কথায় বলা যায় দুর্গম এলাকার সার্ভিস সেন্টার। পাড়া কেন্দ্রের মাধ্যমে পাহাড়ে বসবাসরত মানুষ, বিশেষ করে শিশু, কিশোরী ও নারীদের সেবা দেওয়া হয়। সাধারণত একই ধর্ম ও সম্প্রদায়ের এবং একই ভাষাভাষী ৪০-৫০টি পরিবারকে সেবা দেওয়া হয় একটি কেন্দ্র থেকে। ক্ষেত্র বিশেষে একাধিক সম্প্রদায়ের জন্যও একটি পাড়া কেন্দ্র থাকতে পারে।
পাড়া কেন্দ্রে আসা শিশুদের দেওয়া হয় খাবারএসব কেন্দ্রের মাধ্যমে ৩ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের যত্ন ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাদান, গর্ভবতী ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ দেওয়া, প্রত্যক্ষ পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালনা, স্বল্পব্যয়ে যথোপযুক্ত পদ্ধতি প্রদর্শন ও প্রশিক্ষণ দেওয়া, শিশু সুরক্ষা, শিশু ও নারীর অধিকার নিয়ে ধারণা দেওয়ার মতো কাজগুলো পরিচালনা করা হয়ে থাকে। এছাড়া, কমিউনিটি সদস্যদের আচরণগত পরিবর্তন করা, কমিউনিটির হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণ করা, কমিউনিটি সভা করা, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সামাজিক কাজও চালানো হয় এসব কেন্দ্র থেকে। স্থানীয় একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীকর্মী কেন্দ্রটি পরিচালনা করেন।
এই পাড়া কেন্দ্রগুলোর অর্থায়নে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ। আর এগুলো পরিচালনার দায়িত্বে আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অধীন সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প।
পাহাড়ি শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চলে পাড়া কেন্দ্রেইপার্বত্য চট্টগ্রামের চার হাজার ৭৩৪টি পাড়ার মধ্যে তিন হাজার ৫১৯টি পাড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে পাড়া কেন্দ্র। এর মাধ্যমে এক লাখ ৬৫ হাজার ৩৪৩ পরিবারের আট লাখ ৫৯ হাজার ৭৮৪ জনকে বিভিন্ন সেবা দেওয়া হচ্ছে।
সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প পার্বত্য এলাকার বসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নে মূল্যবান অবদান রেখেছে। জন্ম নিবন্ধন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়ন, পানি ও পয়ঃব্যবস্থার উন্নয়ন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে পার্বত্যাঞ্চলে দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। পাড়াকর্মীদের জ্ঞান ও দক্ষতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে কমিউনিটির অংশগ্রহণ এবং সেবা বিতরণে বিভিন্ন সংস্থার সম্পৃক্ততা পাড়া কেন্দ্রকে তৃণমূল পর্যায়ে সত্যিকার অর্থে সেবা বিতরণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।
পাড়া কেন্দ্র থেকে পাহাড়িদের নিয়ে কমিউনিটি কার্যক্রমও পরিচালনা করা হয়কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের মিটিংগাছড়ি গ্রামের বাসিন্দা রোজিনা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের বাড়ি থেকে স্কুল অনেক দূরে। আমার মেয়ে এই পাড়া কেন্দ্র থেকেই লেখাপড়া করেছে। এ বছর তাকে হাইস্কুলে ভর্তি করেছি। এর পুরো অবদানই পাড়া কেন্দ্রের। স্বাস্থ্যগত সমস্যাতেও আমরা পাড়া কেন্দ্র থেকে অনেক সেবা পেয়েছি।’
মিটিংগাছড়ির ইউপি মেম্বার আশীষ কুমার তঞ্চঙ্গা বলেন, ‘এই পাড়া কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকার শিশুদের স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। খেলার মাধ্যমে লেখাপড়ার বিষয়টি তারা কাজে লাগাচ্ছে। তিন পার্বত্য জেলায় এই পাড়া কেন্দ্রের প্রকল্প অত্যন্ত ফলপ্রসু।’
পাড়া কেন্দ্রে নারী অধিকার নিয়ে সচেতনতা কর্মসূচি চালানো হয়প্রকল্প ব্যবস্থাপক জানে আলম বলেন, ‘বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলার ২৬টি উপজেলায় চার হাজার পাড়া কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। চার হাজারতম পাড়া কেন্দ্রটি রবিবার প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন।’
সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (উপ সচিব) মোহাম্মদ ইয়াছিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাহাড়ের বাতি ঘর হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে পাড়া কেন্দ্রগুলো। আগামী মার্চে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও টেকসই সামাজিক সেবা নামে আগামী ১ এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আরেকটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। আশা করছি, সেটি এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পাস হবে।’
আরও পড়ুন-
রমেকে হিমঘরের ফ্রিজ নষ্ট, লাশ পচে দুর্গন্ধ
বৈরী আবহাওয়ায় সরিষা চাষে ক্ষতির আশঙ্কায় নেত্রকোনার কৃষকরা