সম্প্রতি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন থেকে দেওয়া কেআইবি কৃষি পদক ২০১৮ পেয়েছেন রুবিনা। কৃষিতে অবদান রাখায় নারী খামারি হিসেবে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছেন তিনি। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন বেশ কয়েকটি সম্মাননা। বাড়িয়েছেন সম্পদ। মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে গড়ে তোলা সংসারে এনেছেন সমৃদ্ধি। রুবিনার মা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরেই একটি করে রুবিনা প্রয়োজন। রুবিনা যেকোনও মায়ের জন্যই অহংকার।’
রুবিনা জানান, তিনি সবসময় শাশুড়ি ও শ্বশুরবাড়ির সবার মন জুগিয়েই চলার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাকে সবসময় অবজ্ঞা করা হয়েছে। উদাহরণ টেনে রুবিনা বলেন, “ছোটবেলা থেকেই বাড়ির নলকূপে গোসল করার অভ্যাস আমার। কোনোদিন পুকুরে গোসল করিনি। এটা নিয়ে প্রায়ই শাশুড়ি ও ননদ বকাবকি করত। একদিন ননদ আমাকে জোর করে পুকুরে নামিয়ে দেয়। সাঁতার না জানায় পুকুরের ঘোলা পানিতে আমার ডুবে মরার দশা। কোনোক্রমে জীবন নিয়ে পাড়ে উঠে আসি। পরে ননদ আমাকে বলে, ‘মনে করেছিলাম পানিতে ডুবিয়ে মারব, তাও করতে দিলি না?”
গ্রামের মেয়ে রুবিনার তখন চোখে-মুখে অন্ধকার। একদিকে সংসার ভেঙে যাওয়ার বেদনা, অন্যদিকে রক্ষণশীল সমাজের দুয়োধ্বনি, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ—সব মিলিয়ে রুবিনার সম্বল তখন কেবলই অশ্রু। ঘরে বৃদ্ধা মা রোকেয়া রহমান, ছোট ভাই রুবেল আর ছোট বোন রোখসানাও তখন ওই পরিস্থিতিতে অথৈ সাগরে। এই চাপ সামলে ওঠা কি সমাজের প্রান্তিক এক তরুণীর পক্ষে সম্ভব?
প্রশ্নের জবাব দিলেন রুবিনা নিজেই। বললেন, ‘মনে হয়েছিল আত্মহত্যা করব। বেঁচে থাকার কোনও শক্তিই যেন অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু মা আর ছোট ভাইবোনের দিকে তাকাতেই মনে হয়, আমি না থাকলে ওদের কে বাঁচাবে? মা আর ভাইয়ের চোখের জল আমাকে আত্মহত্যার চিন্তা থেকে সরে আসতে বাধ্য করে।’
রুবিনা তখন ভাবেন, গায়ের রঙ কালো বলে সংসার ভাঙলেও কালো মানুষের কর্ম করতে তো কোনও সমস্যা নেই। কাজ দিয়েই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন। সেলাইয়ের কাজ জানতেন আগে থেকেই। শুরুটাও করেন সেই কাজ দিয়েই। শুরুতে সবার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে একত্রিত করতে থাকেন নির্যাতিত নারীদের। গড়ে তোলেন সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন কৃষি খামার। বাবার রেখে যাওয়া ১০-১২ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন কুল, আম ও পেয়ারা বাগান। বাড়ির পাশের পুকুরে শুরু করেন মাছের চাষ। ওই পুকুরেই শুরু করেন সমন্বিত পদ্ধতিতে হাঁস চাষ। শুরুতে দেড় বিঘা জমিতে ফলের বাগান করলেও এখন আরও সাড়ে ৫ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ফলের চাষ করছেন রুবিনা।
এখানেই শেষ নয়, বাড়ির আঙিনায় দেড়শ কবুতর পালন করছেন রুবিনা। এর বাইরেও রয়েছে ৭৬টি লাভ বার্ড আর এক হাজার কোয়েল পাখি।
নিজের সংসার ভাঙলেও ছোট ভাই রুবেলকে বিয়ে দিয়েছেন রুবিনা। তার একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। আর ছোট বোন রোখসানা রহমান পদার্থবিজ্ঞানে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। মা রোকেয়া বেগমের প্রতিদিনের ওষুধ আর বোনের পড়ার খরচসহ সংসারের সব খরচ বাদ দিয়েও বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আয় করছেন বলে জানান রুবিনা।
রুবিনা বলেন, ‘ইয়ুথ উইমেন্স ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি থেকে নিবন্ধন নিয়েছি। মহিলা বিষয়ক অধিদফতর থেকেও সহায়তা পাচ্ছি। সমবায় সমিতির মাধ্যমে এখন একটি প্রকল্পের কাজ করছি। গ্রামের অবহেলিত নারীদের জন্য এই প্রকল্প থেকে একশটি পরিবারকে দুইশটি গাভী কিনে দেওয়া হবে। প্রতিটি নারীকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা করে ঋণ দিয়ে এই গাভী কিনে দেবো। এক বছর পর গাভীগুলোর বাছুর হলে দুধ বিক্রি করে তারা ৩৬ কিস্তিতে ঋণের টাকা পরিশোধ করবেন।’ পরিবারের বয়োবৃদ্ধ অবহেলিতদের জন্য নাটোরে একটি বৃদ্ধাশ্রম করবেন বলেও ইচ্ছে আছে তার।
নিজে কালো বলে সংসার ভেঙেছে, নিগৃহের শিকার হয়েছেন। তাই রুবিনা চান না, সমাজের আর কোনও মেয়ে এমন নিগৃহের শিকার হোক। রুবিনা বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হওয়ার তা হয়েছে। সংসার হারিয়েছি, কটুকথা শুনেছি। বেঁচে থাকতে পারবো, সেই বিশ্বাসটুকুও ছিল না। আমি চাই না, গায়ের রঙ কালো বলে কিংবা অন্য কোনও তুচ্ছ কারণে আর কোনও মেয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হোক। তাই বিশেষ করে সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত মেয়েদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে আমি আজীবন কাজ করে যেতে চাই।’