‘স্বজনদের সঙ্গে ফোনে এভাবে কথা বলতে পারবো, কখনও ভাবিনি’

বুধবার কার্যক্রম উদ্বোধনের পর মোবাইল ফোনে কথা বলছেন এক বন্দি‘দীর্ঘদিন পর কারাগার থেকে আপনজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে সামনা-সামনি কথা বলার মতোই আনন্দ পেয়েছি। কারাগার থেকেও যে স্বজনদের সঙ্গে ফোনে এভাবে কথা বলতে পারবো, কখনও ভাবিনি।’ পাঁচ বছর ধরে টাঙ্গাইল কারাগারে থাকা টাঙ্গাইলের মধুপুরের লাভলু মণ্ডল এভাবেই তুলে ধরলেন তার ফোনে কথা বলার অনুভূতি। ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত এ আসামি জানালেন, তার জন্য গত বুধবার (২৮ মার্চ) ছিল একটি বিশেষ দিন।

ওইদিন দেশে প্রথমবারের মতো কারাগার থেকে বন্দিদের মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার কার্যক্রমের উদ্বোধন হয়। টাঙ্গাইল কারাগারে শুরু হওয়া এ কার্যক্রম চার কয়েদির কথা বলার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। সেই চার জনের একজন লাভলু মণ্ডল।

স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এই বন্দি। ইতোমধ্যেই বন্দিজীবনের পাঁচ বছর পার করেছেন টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার জটাবাড়ি পূর্বপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।

লাভলু মন্ডল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশে প্রথমবারের মতো বন্দিদের ফোনালাপের কার্যক্রমের উদ্বোধনী দিনে ফোনে কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।’

‘স্বজনের সঙ্গে সংশোধনের পথে’ স্লোগান সামনে রেখে স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলার এই কার্যক্রমের নামকরণ করা হয়েছে ‘স্বজন পরিবারের বন্ধন’। দেশে এই প্রথমবারের মতো টাঙ্গাইলের কারাবন্দিদের ফোনালাপের মধ্য দিয়ে কার্যক্রমটি চালু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশের কারাগারগুলোতে এ সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে  বুধবার (২৮ মার্চ) দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল কার্যক্রমটি উদ্বোধন করেন।

সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন সাজ্জাদ হোসেন। চাকরিবিধি লঙ্ঘনের দায়ে তার এক বছরের সাজা হয়েছে। তিনি তিন মাস ধরে কারাগারে রয়েছেন। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় তার বাড়ি। তিনি বলেন, ‘পরিবারের সঙ্গে কথা বলে অনেক আনন্দ পেয়েছি। বন্দিরা নিয়মিত স্বজনদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারলে তাদের মানসিক স্বস্তি বাড়বে। কারামুক্তির পর বন্দিরা তাদের স্বজনদের কাছে সুস্থ মানসিকতা নিয়ে ফিরতে পারবেন।’

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চাকতা গ্রামের সাহাদত হোসেন। মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ পেয়ে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের খোঁজখবর নেন। কারাবন্দিরা তাদের স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারলে স্বজনদের সুপরামর্শে সুস্থ ও সুন্দর জীবনে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে বলে মত দেন তিনি।

চুয়াডাঙ্গার রাশেদুল ইসলাম নামের এক কারাবন্দিও স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। দীর্ঘদিন পর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পেরে আবেগে আপ্লুত এ বন্দি। সরকার মানবিক দৃষ্টি দিয়ে কারাবন্দিদের ফোনে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে উল্লেখ করে সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।

সরকারের এ উদ্যোগ সম্পর্কে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর এ মানবিক গুণ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। একটি নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার আওতায় বন্দিরা তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলা বা তাদের মুখ দেখতে পারলে তাদের আচরণের পরিবর্তন ঘটবে। কারাগারগুলো প্রকৃত সংশোধনাগার হিসেবে একধাপ এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগ সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন হলে দেশ থেকে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে।’

যেভাবে কথা বললেন কারাবন্দিরা

টাঙ্গাইল জেলা কারাগার সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের (এটুআই) সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড ও বাংলাদেশ জেলের সহায়তায় এ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এই কার্যক্রমের আওতায় বন্দি (হাজতি ও কয়েদি) কারাগারে আসার পর তাদের কাছ থেকে স্বজনদের দুটি ফোন নম্বর রাখা হবে। একজন বন্দি মাসে দুবার ১০ মিনিট করে কথা বলার সুযোগ পাবেন। কথা বলার ক্ষেত্রে নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে কারাগারের ভেতর একটি কক্ষে চারটি ফোনবুথ তৈরি করা হয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলা কারাগারের জেলার আবুল বাশার বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ে কোনও বন্দি বুথে গিয়ে কথা বলতে পারবেন। বুথে ঢুকে নির্দিষ্ট বোর্ডে এক বা দুই চাপলে সফটওয়্যার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট নম্বরে সংযোগ পাওয়া যাবে। নির্ধারিত সময় ১০ মিনিট পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে কল কেটে যাবে। সময় শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে সতর্কসূচক ‘বিপ’ শোনা যাবে। নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে কল ডায়াল হবে না। শুধু নির্ধারিত সময়েই কল করতে হবে।’ বন্দিদের স্বজনরা নির্ধারিত সময়ে যেন কথা বলার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারেন, সেজন্য আগের দিন তাদের মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠানো হয় বলেও জানান তিনি।

টাঙ্গাইলের জেল সুপার মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘বন্দিদের জন্য মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ থাকলেও কিছু কিছু বন্দি সেই সুযোগ পাবে না। তাদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সদস্য এবং অপহরণ ও চাঁদাবাজির মামলায় অভিযুক্তদের জন্য এই সুযোগ রাখা হয়নি। নিরাপত্তার স্বার্থে বন্দিদের প্রতিটি কল রেকর্ড করা হবে। এছাড়াও বুথে সার্বক্ষণিক কারারক্ষী নিয়োজিত থাকবে। বন্দিরা পরিবার-পরিজন নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। এতে মানসিক বিষন্নতা দেখা দেয়। টেলিফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলায়, তাদের বিষন্নতা অনেকটাই লাঘব হবে।’