গারোদের বিশ্বাস ‘মিসি সালজং’ বা শস্য দেবতার ওপর নির্ভর করে ফসলের ভালো ফলন। এই শস্য দেবতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ও নতুন ফসল খাওয়ার অনুমতির পাশাপাশি সব পরিবারের ভালবাসা, আনন্দ এবং মঙ্গল কামনা করে শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে ওয়ানগালা (নবান্ন) উৎসব পালন করেছে গারো সম্প্রদায়।
রবিবার (২৫ নভেম্বর) সকালে ঝিনাইগাতী উপজেলার দুধনাই গ্রামের মরিয়মনগর সাধু জর্জ ধর্মপল্লীতে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও প্রার্থনা পরিচালনা করেন পবিত্র ক্রুশ যাজক সংঘ বাংলাদেশের প্রভিন্সিয়াল ও খামাল ফাদার জেমস ক্লেমেন্ট ক্রুশ, সিএসসি। এসময় সভাপতিত্ব করেন মিশনের পাল পুরোহিত ফাদার সুবল কুজুর সিএসসি।
সকাল সাড়ে ৮টায় স্থানীয় হাইস্কুল মাঠে প্রধান অতিথিকে কুতুব পড়িয়ে এবং খ্রিস্ট পর্বের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করা হয়। এসময় গারোদের ১২টি গোত্রের মানুষ তাদের উৎপাদিত ফসল এনে খ্রিস্টের নামে উৎসর্গ করেন। এরপর উপস্থিত সবাইকে থক্কাদান (কপালে নতুন ধানের চালের গুড়ো দিয়ে ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ) শেষে গির্জায় প্রার্থনা করা হয়। এসময় পবিত্র খ্রিস্টযাগ, দান সংগ্রহ, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিকালে মিশন এলাকার গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে আয়োজন করা হয় নক্গাত্তা অনুষ্ঠানের।
ওয়ানগালা উৎসব আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, এক সময় গারো পাহাড় এলাকায় জুম চাষ হতো এবং বছরে মাত্র একটি ফসল হতো। তখন ওই জুম বা ধান ঘরে উঠানোর সময় গারোদের শস্য দেবতা ‘মিসি সালজং’কে উৎসর্গ করে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। কারণ হিসেবে জানা গেছে, গারোদের ওই শস্য দেবতা এক সময় পাহাড়ি এলাকার গারোদের হাতে কিছু শস্য দিয়ে বলেছিল- তোমরা এটা রোপন কর, তাতে তোমাদের আহারের সংস্থান হবে এবং তোমরা যে শস্য পাবে তা থেকে সামান্য কিছু শস্য আমার নামে উৎসর্গ করবে। এরপর থেকেই গারোরা তাদের শস্য দেবতাকে এই ফসল উৎসর্গ করে আসছে।
কিন্তু গারোরা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথাটি এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে করে পালন করা হয়। অর্থাৎ এক সময় তারা তাদের শস্য দেবতা মিসি সালজংকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করলেও এখন তারা নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রিস্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করেন।
শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী মরিয়মনগর খ্রিস্টান ধর্মপল্লির নিয়ন্ত্রণে জেলার সদর উপজেলাসহ শ্রীবরর্দী, ঝিনাইগাতী এবং জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার গারো সমাজের ৪৭টি গ্রাম রয়েছে। ওইসব গ্রামে প্রায় ২২ হাজার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী গারো সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস।
মরিয়ম নগরের ওয়ানগালা উৎসবটি এবার ৩৩ বছরে পা দিয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে এখানে ওয়ানগালা উৎসব পালন করা হচ্ছে। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য খ্রিস্টভক্ত এবং গারাগানজিং, কতচু, রুগা, মমিন, বাবিল, দোয়াল, মাতচি, মিগাম, চিবক, আচদং, মাতাবেং ও আরেং নামে ১২টি গোত্রের গারো সম্প্রদায়ের লোকজন এবার ওয়ানগালা উৎসবে উপস্থিত হয়েছেন। এদিকে ওয়ানগালা উৎসব উপলক্ষ্যে মিশনের পাশে বসেছে জমজমাট মেলা। মেলায় গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকসহ শিশুদের নানা রকমের খেলনা বিক্রি করা হয়। ফলে এখানে গারো শিশু ও তরুণ-তরুণীরা বিভিন্ন পণ্যের পসড়ার দোকানে তাদের পছন্দের জিনিস কিনতে ভিড় জমান। ওয়ানগালা উৎসবে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে আসা গারো সম্প্রদায়ের লোকজন এবং তাদের আত্মীয়রা একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দেখা হওয়ায় অনেকটা বড় দিনের উৎসবের মতো আনন্দ উপভোগ করেন।