দোকান কর্মচারী থেকে দুর্ধর্ষ বোমাবাজ

গোলাম হোসেন লিটন ওরফে বোমা লিটন একসময় দোকান কর্মচারী ছিল সে। ১২ বছর বয়সে ধোলাইখালের এক দোকানে কর্মচারী হিসেবে যোগ দিয়েছিল। মটর পার্টসের দোকান। পড়ালেখা করেনি। সেই দোকান কর্মচারী থেকেই প্রথমে যোগ দেয় পুরান ঢাকার এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত শহীদের দলে। ধীরে ধীরে দক্ষ হয়ে ওঠে বোমা তৈরিতে। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। তার নাম গোলাম হোসেন লিটন (৪০)। বোমাবাজ হওয়ায় তার নামই হয়ে যায় ‘বোমা লিটন’।

এক পর্যায়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়েও বোমা তৈরি করে সরবরাহ করা শুরু করে লিটন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। গত বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) কাফরুল এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পল্লবী জোনাল টিম। আদালতে সোপর্দ করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত তাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (পল্লবী জোনাল টিম) সিনিয়র সহকারী কমিশনার শাহাদত হোসেন সুমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বোমা লিটনকে আমরা বহুদিন ধরেই খুঁজছিলাম। আগে সরাসরি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিল লিটন। এরপর সে বোমা তৈরির কারিগর হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বোমা ও ককটেল তৈরি করে দেওয়ার কাজ করত। বোমা তৈরি করার বিনিময়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে ঢাকার ওয়ারীতে একটি বাড়িও করেছে সে।’

ডিবি সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা লিটনের বাবার নাম মৃত মাইনু মিয়া। ৫৩/এ, লালমোহন স্ট্রিটে পরিবারের সঙ্গে থাকত সে। ছোটবেলা থেকেই দুষ্ট প্রকৃতির হওয়ায় স্কুলে পড়া হয়নি তার। ডানপিটে হওয়ার কারণে ১২ বছর বয়সেই তাকে মটর পার্টসের দোকানে কাজে ঢুকিয়ে দেয় পরিবারের সদস্যরা। মটর পার্টসের দোকানে কাজ করতে করতেই ওয়ারীর যুবসংঘ ক্লাবে যাতায়াত শুরু করে সে। সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় একসময়ের আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও পুরান ঢাকার ত্রাস ডাকাত শহীদের সঙ্গে। ধীরে ধীরে ডাকাত শহীদের দলের যুক্ত হয়ে যায় সে।

সূত্র জানায়, ডাকাত শহীদের দলে কাজ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে বোমা তৈরিতে দক্ষ হয়ে ওঠে লিটন। ডাকাত শহীদের হয়ে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি করতে তারা সে সময় বোমার ব্যবহার করত। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই তার বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের সামনে বোমা ফাটিয়ে আসত। এভাবেই তার নাম হয়ে যায় বোমা লিটন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১২ সালের ৩ জুলাই পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকায় সহযোগীসহ র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ডাকাত শহীদ। এরপর বোমা লিটন কিছুদিন আত্মগোপনে থাকে। পরিস্থিতি অনুকূলে এলে আবারও সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু করে। বোমা তৈরিতে সিদ্ধহস্ত হওয়ার কারণে গত কয়েক বছরে বিরোধী রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতাকর্মী তার কাছ থেকে বোমা ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করত। বিএনপি সমর্থক পরিচয়ধারী বোমা লিটন বোমা তৈরি ও সরবরাহ করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যে আন্দোলন করেছিল সেখানেও বোমা লিটন বোমা সরবরাহ করেছে। এরপর থেকে সে ধারাবাহিকভাবে বোমা তৈরি ও সরবরাহ করে এসেছে। সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনের সময়ও বোমা তৈরি করে সরবরাহ করেছিল বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল। কিন্তু চতুর লিটন যোগাযোগের জন্য সরাসরি কোনও মোবাইল ফোন ব্যবহার করত না।

ডিবি সূত্রের দাবি, লিটনকে ধরতে তারা প্রযুক্তির ব্যবহার করে যখন সফল হচ্ছিলেন না, তখন প্রথাগত সোর্স নিয়োগ করেন। সেই সোর্সের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই গত বৃহস্পতিবার কাফরুল এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। পরে তাকে কাফরুল থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়।

ডিবি কর্মকর্তারা জানান, বোমা লিটনের নামে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অনেকগুলো মামলা রয়েছে। ওয়ারী থানাতেই সন্ত্রাস বিরোধী আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে এগারোটি মামলা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে আরও মামলার খোঁজ করা হচ্ছে। আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে অবলীলায় তার সকল অপকর্মের কথা স্বীকার করেছে। ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ২ আগস্ট মিরপুরের ১৪ নম্বরে পুলিশ অর্ডার ম্যানেজমেন্ট ও পুলিশ লাইনের গেটের সামনে নাশকতায় অংশ নিয়েছিল বলেও স্বীকার করেছে লিটন।

পুলিশ কর্মকর্তা শাহাদত হোসেন সুমা জানান, লিটন বোমা তৈরির জন্য রসদ যাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করত এবং যাদের কাছে বোমা তৈরি করে সরবরাহ করত তাদের সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া তার তিন সহযোগী রুবেল, মিলন ও রবিন সম্পর্কে কিছু তথ্য সে জানিয়েছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে তাদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।