শুধু মনোজ ব্যাপারিই নন। করোনাভাইরাসের কারণে রফতানি বন্ধ থাকায় কাঁকড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা ও তালতলী উপজেলার চাষিরা। অনেকেই পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হতে চলেছেন। একদিকে লোকসান আর অন্যদিকে ঋণের বোঝায় দিশেহারা হয়ে হতাশার মধ্যে দিন কাটছে তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরগুনার পাথরঘাটা ৪৭০টি ঘেরে পাঁচ শতাধিক চাষি কাঁকড়া চাষ করেছেন। স্বল্প সময়ে উৎপাদন, চীনে ভালো চাহিদা ও দাম থাকায় উপজেলায় গত কয়েক বছরে কাঁকড়া চাষি যেমন বেড়েছে, তেমনি গড়ে উঠেছে নতুন নতুন কাঁকড়া চাষের ঘের। কিন্তু হঠাৎ চীনে করোনাভাইরাস ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় উৎপাদিত কাঁকড়া রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বরগুনায় মাত্র তিন মাসে পরিপক্ব ও ডিমওয়ালা কাঁকড়াগুলো ঘেরেই মরেছে অধিকাংশ। এদিকে দেশের বাজারে কাঁকড়ার চাহিদা না থাকায় দাম কমেছে কয়েকগুণ। যেখানে কেজি প্রতি যে কাঁকড়া ২২০০ থেকে ২৮০০ টাকায় বিক্রি হতো, তা এখন ২শ’ থেকে আড়াইশ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হতে চলেছেন কাঁকড়া চাষিরা। কাঁকড়া চাষিদের প্রত্যেকের আছে ঋণের বোঝা।
কাঁকড়া চাষি মনোতোষ বলেন, ‘এক একটি ঘের করতে আমাদের খরচ হয় দুই লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। আর এসব টাকারই ব্যবস্থা করা হয় এনজি ঋণ, ব্যাংকের ঋণ অথবা মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসের মধ্যে সবার দেনা পাওনা পরিশোধ করে দেই। এবার আর কিছুই করতে পারছি না। বড় বড় কাঁকড়া ঘেরেই মরে যাচ্ছে। সরকারিভাবে সহায়তা না করলে পরিবার পরিজন নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে।’
কাঁকড়া চাষি শিমুল মন্ডল বলেন, ‘সময়মতো কাঁকড়া বিক্রি না করতে পারায় সব ঘের নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু কিছু ঘেরের পানি শুকিয়ে গেছে। এবছর করোনাভাইরাস আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।’
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁকড়া আড়তদার সমিতির সভাপতি উত্তম মজুমদার বলেন, ‘প্রতিবছর কাঁকড়া চাষিদের দাদন দিতে হয়ে কাঁকড়া চাষ করানোর জন্য। তারা কাঁকড়া বিক্রি করেই সেই টাকা ফেরত দেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে রফতানি বন্ধ থাকায় দাদনের টাকা তো দূরে থাক, চাষিদের পারিশ্রমিকের টাকা উঠানোই দায়। সঠিক সময় তুলে বিক্রি করতে না পারায় অধিকাংশ ঘেরেই কাঁকড়া মরে গিয়েছে। এই অবস্থায় না পারছি চাষিদের কাছে টাকা চাইতে, না পারছি ওদের সহায়তা করতে।’
‘কাঁকড়া চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি’ শীর্ষক ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্পের সহকারী ভ্যালু চেইন ফ্যাসিলেটর গোলাম মোর্শেদ রাহাত বলেন, ‘কাঁকাড়া চাষিদের যে দুর্দিন, তা অসহনীয়। বরগুনার পাথরঘাটায় যেসব কাঁকড়া চাষি রয়েছেন তারা সবাই এখন বিপদগ্রস্ত। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে বিত্তবান থেকে শুরু করে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ থাকবে যাতে কাঁকড়া চাষিরা নিরাপদে থাকতে পারে সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য।’
তিনি আরও জানান, গত বছর প্রায় ৯ হাজার কেজি কাঁকড়া উৎপাদন হয়েছে। চলতি বছরে উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ হাজার কেজি কাঁকড়া। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে।
পাথরঘাটা উপজেলা জেষ্ঠ্য মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু বলেন, ‘এই মুহূর্তে কাঁকড়া চাষিদের আর্থিক সহায়তা না করা গেলেও যাতে কাঁকড়াগুলো না মারা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু করোনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় হয়তো কাঁকড়াগুলো ঘেরেই মারা যাবে।’