অধিকাংশ ইউনিয়নের তালিকাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তার আত্মীয়-স্বজন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মী এবং তাদের পরিবারসহ পছন্দের লোকজনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রকৃত দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের নাম বাদ গেলেও তালিকায় উঠেছে সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম।
সাদুল্লাপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি অনিয়ম, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে ১১নং খোর্দ্দকোমরপুর ইউনিয়নের ৫৯৪ জনের নামের তালিকায়। আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও নিজের পছন্দের অনেক ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্তের অভিযোগ উঠেছে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান চৌধুরী শামীমের বিরুদ্ধে। তিনি তালিকার ৩২১ নম্বরে ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যানের স্ত্রী, ৩৫২ ও ৩২২ নম্বরে রিনা ও নাজমা নামে সংরক্ষিত দুই নারী সদস্যকে বানিয়েছেন কৃষক ও দিনমজুর। তালিকার ২২০, ২২৭ ও ২২৯ নম্বরে ওই দুই ওয়ার্ড সদস্যের তিন ছেলের নামও রয়েছে। পাশাপাশি তালিকার ১৮১ ও ৩১২ নম্বরে খতিজা ও নাহিন নামে দুই দরিদ্র নারীর নামের পাশে নিজ স্ত্রী ও মেয়ের মোবাইল নম্বর ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।
তালিকার ২৬৯ ও ২৭০ নম্বরে রয়েছে রবিউল ও লুৎফর নামে দুই ভাই। তারা দুজনই অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী এবং এলাকাতে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত হলেও তালিকাতে কৃষক পেশা উল্লেখ করেছেন। তালিকার ২৪৭ নম্বরে ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা, ৪৬২ নম্বরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্মচারী, ২৫০ নম্বরে হাইস্কুলের কর্মচারী, ৪৫৭ নম্বরে সরকারি ঘর ও রেশন কার্ডের সুবিধাভোগীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ৪৯৩ ও ৪৯৪ নম্বরে দুজনের নাম থাকলেও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে অন্য ব্যক্তির। এমনকি ১৮৫ নম্বরে থাকা ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া আছে বগুড়া জেলার গাবতলীর মহিষবান মধ্যপাড়ার অন্য একজনের। পুরো তালিকাজুড়েই এমন অনেক ব্যক্তির নাম দেখা যায়।
স্থানীয় এলাকাবাসী ও একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, প্রৃকত হতদরিদ্রদের বঞ্চিত করে আত্মীয়-স্বজনসহ নিজের পছন্দের লোকজনের তালিকা করেছেন চেয়ারম্যান শামীম। তালিকায় অনেকের নাম থাকলেও চেয়ারম্যান তার পরিবারের লোকজন ছাড়াও ব্যক্তিগত লোকজনের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে বিশেষ সহায়তার এই অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
ফুলবাড়ি গ্রামের হালিম জানান, দুই হাজার ৫০০ টাকা পাওয়ার চেয়ারম্যান তাদের কাছে ৫০০ টাকা করে দাবি করেন। পরে পরিষদে গিয়ে চেয়ারম্যানের হাতে ৫০০ টাকা দেন তিনি। তার মতো চেয়ারম্যান অনেকের কাছে দাবি করে টাকা আদায় করছেন। একই গ্রামের ভোলা শেখ বলেন, ‘চেয়ারম্যানের দাবি করা ৫০০ টাকা দিতে পরিষদে যাই। সে সময় চেয়ারম্যান না থাকায় তার পিএস রাজ্জাকের কাছে প্রথমে ২০০ ও পরে আরও ২০০ টাকাসহ মোট ৪০০ টাকা দিই।’ একই গ্রামের বিধবা রোকেয়া বেওয়া বলেন, ‘৫০০ টাকার জন্য চেয়ারম্যান আমার বাড়িতে মাহাফুজা নামে এক মেয়েকে পাঠায়। পরে মাহাফুজার কাছে ৫০০ টাকা দিই।’
ফুলবাড়ি গ্রামের চামেলি বেগম বলেন, ‘আমার শ্বশুর নানা রোগে অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন। শাশুড়িসহ তার ভোটার আইডি কার্ড ও মোবাইল নম্বর চেয়ারম্যানকে দিয়ে আসেন। কিন্তু তালিকায় তাদের নাম উঠলেও তাতে মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া আছে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত লোক রাজ্জাকের।’ এমন প্রতারণার জন্য রাজ্জাক ও চেয়ারম্যানের শাস্তির দাবি জানান তিনি।
এছাড়া সুইটি নামে অপর এক নারী জানান, তালিকাতে তার নাম ও ভোটার আইডি নম্বর ঠিক থাকলেও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে রাজ্জাক নামে একজনের। তার টাকা হাতিয়ে নিতে চেয়ারম্যান ও রাজ্জাক পরিকল্পনা করে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়েছেন বলেও অভিযোগ তার।
গাছুর বাজার এলাকায় লাভলু নামে অপর এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া দুই হাজার ৫০০ টাকা আসার ম্যাসেজ মোবাইল ফোনে আসে। পরে চেয়ারম্যান তার নম্বরে ফোন করে আমার স্ত্রীর কাছে মিষ্টি খাওয়ার জন্য টাকা দাবি করেন। চেয়ারম্যান নানা খরচ ও সমস্যার কথা বলে এ টাকা দাবি করেন।’ চেয়ারম্যানের টাকা দাবির কথোপকথন তার ফোনে রেকর্ড করা আছে বলেও দাবি করেন লাভলু মিয়া।
এদিকে, নিজেদের গরিব ও কর্মহীন দাবি করে বিশেষ সহায়তার এই টাকা পাওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন খোর্দ্দকোমরপুর ইউনিয়নের নারী সদস্য নাজমা বেগম ও রিনা বেগম, আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন এবং সাবেক চেয়ারম্যানের স্ত্রী শাহানাজ। রুহুল আমিন বলেন, ‘দীর্ঘ এক যুগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। বর্তমানে নানা কারণে সাংসারিক অবস্থা ভালো না। ছেলে-মেয়ে বেকার হয়ে বসে আছে। তাই উপায় না পেয়ে তালিকায় নাম দিয়েছি।’ ঈদের পরে তার মোবাইলে টাকাও এসেছে বলে জানান তিনি।
ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমানের স্ত্রী শাহানাজ বেগম মোবাইলে টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ায় বর্তমান চেয়ারম্যান ও মেম্বার আমার নাম মোবাইল নম্বর তালিকাভুক্ত করেন।’
তালিকায় নয়-ছয় আর স্বজনপ্রীতির এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে খোর্দ্দকোমরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুন মণ্ডল বলেন, ‘ত্রাণ বিতরণ আর দুই হাজার ৫০০ টাকার তালিকাতে যে অনিয়ম হয়েছে তাতে শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। পুরো ইউনিয়নজুড়েই নানা অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটলেও নিজ ইচ্ছে ও খেয়ালখুশি মতো পরিষদের কার্যক্রম চালাচ্ছেন চেয়ারম্যান।’ দ্রুত এসব অনিয়মের অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্ত শাস্তির দাবি জানান তিনি।
সুবিধাভোগীদের কাছে টাকা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘রমজান মাসে অল্প সময়ের মধ্যে তালিকা তৈরি করতে গিয়ে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা, পরিষদের সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের দেওয়া নাম সমন্বয় করে ৫৯৪ জনের তালিকা জমা দেওয়া হয়। তবে তালিকা পাঠানোর পর তথ্য কেন্দ্রে মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে রাজ্জাকের নম্বর দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি জানার পর রাজ্জাক ও উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’ এছাড়া তার মেয়ের নম্বরে আসা টাকা ভুক্তভোগীর কাছে দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। তবে অভিযুক্ত রাজ্জাকের মোবাইল নম্বরে বারবার কল করলেও তিনি ধরেননি।
তালিকায় অনিয়মের অভিযোগের বিষয় জানা আছে জানিয়ে সাদুল্লাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নবী নেওয়াজ বলেন, ‘অনিয়মের বিষয়টি দ্রুত খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এছাড়া এমন অনিয়মের সাথে জড়িতদের কোনও ছাড় নেই জানিয়ে গাইবান্ধা-৩ (সাদুল্লাপুর-পলাশবাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নগদ সহায়তার তালিকায় অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির ঘটনা তদন্ত করা হবে। তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, গাইবান্ধা জেলার হতদরিদ্র ও কর্মহীন ৭২ হাজার পরিবারকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এ পর্যন্ত জেলার সাত উপজেলার প্রায় ১০ হাজার পরিবার সহায়তার এই টাকা পেয়েছে বলে জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।