বগুড়া প্রতিনিধি জানান, যমুনার পানি এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার (১ জুলাই) দুপুরে সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এদিকে বন্যার কারণে জেলার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার যমুনা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। বন্যা আক্রান্তদের অনেকে গবাদিপশু ও আসবাবপত্র নিয়ে আশপাশের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও আশ্রয়ণ প্রকল্পে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গবাদিপশুর খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সারওয়ার আলম জানান, ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে বোহাইল, কর্ণিবাড়ি, কাজলা ও চালুয়াবাড়ি সম্পূর্ণ এবং সারিয়াকান্দি সদর, হাটশেরপুর, চন্দনবাইশা ও কামালপুর আংশিক প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ৬৮টি গ্রামের ১২ হাজার ৪০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল হালিম জানান, যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন গ্রামের ৩৫ হাজার ৩৯০ কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এদের চার হাজার ৫৮৫ হেক্টর জমির পাট, এক হাজার ৯২০ হেক্টর আউশ ধানের জমি, ৫০ হেক্টর সবজির জমি, ৬০ হেক্টর রোপা আমন বীজতলা, দুই হেক্টর মরিচের জমি ও ১৫ হেক্টর ভুট্টার জমি পানিতে ডুবে গেছে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, বুধবার বেলা ১২টার দিকে যমুনা নদীর সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল মিয়া জানান, মঙ্গলবার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের সুজানেরপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৪০০ পরিবারের মাঝে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। অন্যান্য এলাকায়ও ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে।
এদিকে সোনাতলা উপজেলায় যমুনা ও বাঙালি নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েকদিনে তেকানীচুকাইনগর, পাকুল্লা ও মধুপুর ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের সাড়ে ১৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। অনেকে তাদের বাড়িঘর ভেঙে গবাদিপশু ও আসবাবপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন। করোনাভাইরাসের কারণে কর্মহীন মানুষরা বন্যা কবলিত হওয়ায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। মধুপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসীম কুমার জৈন এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
সোনাতলা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জানান, ২০ টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এছাড়াও নগদ এক লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ টাকা বিতরণ শুরু হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা ও যমুনাসহ আত্রাই, গোমতি, চিকনাই, হুরাসাগর, চলনবিলে পানি বাড়তে শুরু করেছে। নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে নদীপাড়, তীরবর্তী এবং নিম্নাঞ্চল প্লাবিতসহ ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে পাবনার সুজানগর, বেড়া ও ঈশ্বরদী উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম। বেড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ বলেন, বুধবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেব মতে যমুনা নদীর নগরবাড়ি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অন্যদিকে পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোফাজ্জল হোসেন বলেন, পানি বৃদ্ধি পেলে অল্প সময়ের মধ্যেই নিম্নাঞ্চল ডুবে যাওয়াসহ নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করবে।
জামালপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ২ সেন্টিমিটার কমে বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বেড়েছে ব্রহ্মপুত্রসহ শাখা নদীর পানি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার তিন লাখেরও বেশি মানুষ। যমুনার পানি ১ সেন্টিমিটার কমলেও ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাইসহ শাখা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। নতুন করে জামালপুর সদরের তুলশিরচর, লক্ষ্মীরচর এবং মাদারগঞ্জের চরপাকেরদহ ও কড়ুইচুরা ইউনিয়ন বন্যা প্লাবিত হয়েছ। সব মিলিয়ে ৭ উপজেলার ৪২টি ইউনিয়নে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিন লাখেরও বেশি মানুষ। পানি বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানীয় ও আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে জমির ফসল। পানিবন্দি অবস্থায় দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত দুর্গত এলাকায় ৬০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নদীর পানি কমতে শুরু করায় উঁচু এলাকাগুলো থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। তবে হাওর ও সুনামগঞ্জ শহরের নিচু এলাকার পানি এখনও স্থির অবস্থায় রয়েছে। সুনামগঞ্জ শহরের নিচু এলাকার সড়কে নৌকা দিয়ে লোকজন শহরে আসা-যাওয়া করছেন। গতকাল বৃষ্টি না হওয়ায় পানি দ্রুত নিচে নেমে গেলেও আজ সকালে পানি স্থির হয়ে আছে। পৌর এলাকার ৪০ ভাগ ঘরবাড়ি ও আঙিনায় এখনও বন্যার পানি রয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসনের বন্যা পরিস্থিতি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জেলায় এক লাখ ২১ হাজার ৩৫৪টি পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া তিন হাজার ২৬৫ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল, চিড়া, মুড়ি, গুড়, বিস্কুট, দিয়াশলাই, মোমবাতি, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে চাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। শুকনো খাবারের প্যাকেটের পাশাপাশি গো-খাদ্যের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, জেলায় তিস্তার পানি কমেছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বুধবার (১ জুলাই) ডালিয়া পয়েন্টে সকাল ৬টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত নদীর পানি বিপদসীমার ২৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। ওই পয়েন্টে বিপদসীমা (৫২ দশমিক ৬০) সেন্টিমিটার। এর আগে গত শুক্রবার ওই পয়েন্টে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপরে দিয়ে প্রবাহিত হলে তা অব্যাহত থাকে রবিবার পর্যন্ত। সোমবার (২৯ জুন) সকালে পানি কমতে শুরু করে। তিস্তায় পানি বাড়ায় জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী ও গয়াবাড়ি ইউনিয়নের তিস্তা নদীবেষ্টিত প্রায় ১৫টি গ্রামের তিন হাজার ২২০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও খগাখড়িবাড়ি ও ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নে ৬৯ পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়।
ডিমলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়শ্রী রাণী রায় বলেন, ‘বন্যায় উপজেলায় তিন হাজার ২২০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীভাঙনের শিকার হয়েছে ৬৯টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণের জন্য ১২৫ মেট্রিক টন চাল ও দেড় লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে, তা বিতরণের কাজ চলছে।’