টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

উজানের দিকে অবস্থিত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে নেমে আসা পানির ঢল ও টানা কয়েকদিনের অতিবর্ষণের ফলে দেশের নদীগুলোতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে, গতি বেড়েছে পানির প্রবাহে। ফলে দেশের নদীবেষ্টিত এলাকা ও নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে গেছে, পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব অঞ্চলের মানুষ, তলিয়ে গেছে পাথারের পর পাথার ফসলের ক্ষেত, গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার লোক। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ ও সার্বিক পরিস্থিতি বিষয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধিরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

107901488_284412842795802_5438969620437217157_n

জামালপুর প্রতিনিধি জানান, কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণ ও পার্শ্ববর্তী ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জামালপুর জেলায় দ্বিতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার ৭টি উপজেলায় বন্যার পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) বিকাল ৩টা নাগাদ ৬১সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে যমুনার বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-এর জামালপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু সাঈদ এবং পানি মাপক গেজ পাঠক আব্দুল মান্নান এসব তথ্য জানিয়েছেন।

দেওয়ানগঞ্জ বাজার রেল স্টেশনে বন্যার পানি ওঠার কারণে ঢাকা দেওয়ানগঞ্জ রুটের ট্রেনগুলো দেওয়ানগঞ্জ বাজার স্টেশন পর্যন্ত না গিয়ে ইসলামপুর স্টেশন পর্যন্ত চলাচল করবে বলে নির্দেশনা দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। দেওয়ানগঞ্জ বাজার রেলস্টেশনের মাস্টার আব্দুল বাতেন বাংলা ট্রিবিউনকে এই তথ্য জানিয়েছেন।

এদিকে জেলার দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ, বকশীগঞ্জ, জামালপুর সদর ও সরিষাবাড়ি ৭ উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় ৪০টি ইউনিয়নের বিস্তৃর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি পড়েছে। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ উচু বাঁধে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।

107576557_3673244542703016_5172104092757419876_n

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দ্বিতীয় দফা বন্যায় জামালপুরে ৩১০ মেট্রিক টন জিআর চাল, নগদ ১০ লাখ টাকা ত্রাণ বরাদ্ধ পেয়েছে, তারমধ্যে ৭ উপজেলায় এখন পর্যন্ত ২১০ মেট্রিক টন চালসহ নগদ ১০ লাখ টাকাসহ ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট ১০০ মেট্রিক টন জিআর চালসহ ঈদ উপলক্ষে ৩৪০৮.৫৭০ মেট্রিক টন ভিজিএফ চাল বরাদ্ধ রয়েছে, বুধবার থেকে এসবের বিতরণ কাজ শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা নায়েব আলী।

দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা পানি ও টানা বর্ষণের ফলে দিনাজপুর জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অনেকের বাড়ির সামনে পানি চলে এসেছে। তবে বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে পানি এলে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।

দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (মঙ্গলবার ১৪ জুলাই) দুপুর ১২টার পরিমাপ অনুযায়ী, শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত পুনর্ভবা নদীর ৩৩ দশমিক ৫০ মিটার বিপদসীমার বিপরীতে বর্তমানে পানির স্তর রয়েছে ৩২ দশমিক ৬০ মিটার, আত্রাই নদীর ৩৯ দশমিক ৬৫ মিটারের বিপরীতে বর্তমানে ৩৯ দশমিক ৯৬ মিটার ও ইছামতি নদীর পানি ২৯ দশমিক ৯৫ মিটারের বিপরীতে ২৮ দশমিক ৯৮ মিটারে অবস্থান করছে। এছাড়াও জেলার অন্যান্য ছোট নদীর পানিও বৃদ্ধি পেয়েছে।

দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সার্ভেয়ার ইলিয়াস আলী বলেন, ইতোমধ্যেই নদীর পানি নিচে নেমে যেতে শুরু করেছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ২ সেন্টিমিটার করে পানি নিচে নেমেছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আর বৃষ্টিপাত না হলে এবং উজান থেকে পানি না এলে জেলায় বন্যা হওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই।

107652438_667181397343321_277321734766839431_n

রাজশাহীতে পদ্মার পানি বৃদ্ধির তথ্য জানিয়েছেন আমাদের রাজশাহী প্রতিনিধি। রাজশাহীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার এনামুল হকের বরাত দিয়ে তিনি জানান, মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) সকাল ৬টায় ১৫ দশমিক ৭৬ সেন্টিমিটার, সকাল ৯টায় ১৫ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার, বেলা ১২টায় ১৫ দশমিক ৮৩ সেন্টিমিটার, বেলা ৩টায় ১৫ দশমিক ৮৬ সেন্টিমিটার ও সন্ধ্যা ৬টায় ১৫ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজশাহীতে পদ্মার পানির বিপদসীমার উচ্চতা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার এনামুল হক জানান, সোমবার (১৩ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টার দিকে পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ১৫ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার।

নাটোর প্রতিনিধি জানান, জেলার সিংড়া পয়েন্টে আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সিংড়া ও নলডাঙ্গা উপজেলায় তলিয়ে গেছে ২২৮০ হেক্টর জমি। একই সঙ্গে পানিবন্দি অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন ৩৫০ পরিবার। এদের মধ্যে কিছু পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় ইতোমধ্যেই ৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রস্তুত করা হচ্ছে আরো ১১টি আশ্রয়কেন্দ্র। তবে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি।

108655690_306250183908697_3483561981400517175_n

নাটোর পানি উন্নয়নবোর্ডের নিড়বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান জানান, মঙ্গলবার পর্যন্ত আত্রাই নদীর পানি সিংড়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে জেলার অন্যান্য নদীর পানি এখনও বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক সুব্রত কুমার জানান, পানি বৃদ্ধির কারণে সিংড়া ও নলডাঙ্গা উপজেলা এলাকায় মোট ৩৯ হেক্টর জমির রোপা আমন বীজতলা, ২২ হেক্টর জমির রোপা আমন ধান, ৫৫ হেক্টর জমির রোপা আউশ ধান, ২১৫৯ হেক্টর জমির বোনা আমন ধান ও ৫ হেক্টর জমির সবজি তলিয়ে গেছে।

সিংড়া উপজেলার ছাতারদিঘী ইউপি চেয়ারম্যান আলতাব হোসেন, চামারী ইউপি চেয়ারম্যান রশিদুল মৃধা ও সিংড়া পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌসের সঙ্গে কথা বলে সহস্রাধিক মানুষের পানিবন্দু থাকার তথ্য জানা গেছে।

নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, হালতিবিল এলাকার খাজুরা ও পিপরুল ইউনিয়ন মূলত নিচু এলাকা। বর্ষাকালে এসব এলাকার গ্রামগুলোর চারদিক পানিতে পূর্ণ হয়ে যায়। তখন এলাকার গ্রামগুলোকে দ্বীপের মত মনে হয়। এবারও তাই হয়েছে। ফলে অনেক জমির ফসল তলিয়ে গেছে।

107821021_585302822168577_1364008468164756234_n

যমুনা নদীর পানি আরিচা পয়েন্টে বিপদসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি। তিনি জানান, মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৬টার দিকে মানিকগঞ্জ পানিবিজ্ঞান শাখার পানির স্তর পরিমাপক মো. ফারুক আহম্মেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, 'যমুনা নদীর আরিচা পয়েন্টের পানির বিপদসীমা হচ্ছে ৯ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার। বিকাল ৬টা পর্যন্ত যমুনা নদীতে ৯ দশমিক ৪৬ সেন্টিমিটার অর্থাৎ বিপদসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনা নদীর পানি। যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে মানিকগঞ্জের নিম্নাঞ্চল অর্থ্যাৎ শিবালয়, দৌলতপুর এবং ঘিওর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার নদ-নদী ও খাল-বিলে পানি প্রবেশ করছে।'

মানিকগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শাহজাহান আলী বিশ্বাস জানান, পানির বৃদ্ধির ফলে জেলার প্রায় ৪ হাজার হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে।