গাইবান্ধায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় আড়াই লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত

পানিতে নষ্ট হয়েছে জেলার দুই হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল পরপর তিন দফার দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় গাইবান্ধার ছয় উপজেলার ৪৪টি ইউনিয়নের ৩৫ হাজার ৫৫১টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির শিকার হয়েছেন এসব পরিবারের দুই লাখ ৫২ হাজার ৭৮৬ জন মানুষ। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে কেউ ঘরবাড়ি ও পুকুরের মাছ, কেউ জমির ফসল হারিয়ে হয়েছেন নিঃস্ব। দুর্গত এলাকায় পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে শিশুসহ চার জনের। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয় ছয় উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকার তিন হাজার ২৩৬ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর বন্যার পানিতে তলিয়ে বীজতলা, আউশ ধান, পাট, ভুট্টা, বাদাম ও শাকসবজিসহ জেলার দুই হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ হেক্টর বীজতলা, এক হাজার ৯০০ হেক্টর পাট, ৪০ হেক্টর বাদাম, ১৬০ হেক্টর আউশ ধান ও ২৭০ হেক্টর জমির শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব মিলে এবার বন্যায় ১২ কোটি ৭২ লাখ টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জেলার ২৭ হাজার ছোট, মাঝারি ও প্রান্তিক কৃষক। ফলে পরবর্তী চাষাবাদ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।

দফায় দফায় বন্যার পানিতে ভেসে গেছে জেলার ছয় উপজেলার ছোট-বড় ৯৪৩টি পুকুর ও খাল-বিলের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। সেই সঙ্গে পানির চাপে পুকুরের পাড়ও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা মৎস কর্মকর্তা মো. আবু দাইয়ান জানান, আকস্মিক বন্যায় নয় শতাধিক পুকুর-জলাশয়ের মাছ ভেসে গেছে। এসব পুকুর ও জলাশয়ে বিভিন্ন এলাকার ৬৭৭ জন পেশাদার মৎস্যচাষি মাছ চাষ করেন। কিন্তু বন্যায় মাছ ভেসে যাওয়ায় এসব মৎসজীবী স্বল্প পুঁজি হারিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। মাছ ভেসে যাওয়ায় জেলার মৎস্যজীবীদের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট মৎস্য অধিদফতরে আবেদন করা হয়েছে।

এদিকে, বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুর্গত এলাকার ২৪.২০ কিলোমিটার গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক। আংশিক ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ১৩টি ছোট ব্রিজ ও কালভার্ট। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৫২টি স্থান। বাঁধ ও রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় ফলে চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষকে।

টটবন্যা দুর্গত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গত পাঁচ দিন ধরে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনা, ঘাঘট ও করতোয়াসহ জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় ধরে জেলার সদর, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি, গোবিন্দগঞ্জ ও সাদুল্লাপুর উপজেলার আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। নদ-নদীর পানি কমায় তলিয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি জেগে উঠছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ আর উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেওয়া দুর্গত মানুষরা তাদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের কাঁচা ঘরবাড়ি দীর্ঘদিন পানিতে নিমজ্জিত থাকায় অধিকাংশ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর মেরামত করতে না পেরে অনেকে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আয়-রোজগারের পথ বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়ে শঙ্কিত নিম্ন আয়ের মানুষরা। পাশাপাশি বন্যার্ত মানুষের হাত ও পায়ে চুলকানিসহ নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। তবে দুর্গত এলাকায় মেডিক্যাল টিম এবং প্রয়োজনীয় কোনও ওষুধ-সেবা মিলছে না বলে অভিযোগ বানভাসি মানুষের।

গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনের হিসাবে, উজানের ঢল ও অবিরাম বৃষ্টিপাতে গাইবান্ধা জেলার সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, সাদুল্লাপুর ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলাসহ ছয়টি উপজেলার ৪৪টি ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। তিন দফা বন্যার কারণে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ৩৫ হাজার ৫৫১টি পরিবারের ২ লাখ ৫০ হাজার ৭৮৬ জন মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিতে ডুবে শিশুসহ চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বন্যায় অন্য যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো কাজ করছে বলে জানান জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন।

তিনি আরও জানান, বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় দুর্গত এলাকার মানুষরা ঘরে ফিরছেন। এ পর্যন্ত বন্যার্তদের মধ্যে ৫১০ মে. টন চাল, ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৫ হাজার ৬৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। চিকিৎসা সেবায় ৮০টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে।

বন্যায় ঘরবাড়ি হারানো ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তার পাশাপাশি কৃষি ও মৎস চাষের ক্ষতি পুষিয়ে নিতেও প্রয়োজনীয় সহায়তার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক।