বগুড়ায় ঐতিহ্যবাহী ‘পোড়াদহ মেলা’ অনুষ্ঠিত

বগুড়ার গাবতলীতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় দুই শতাধিক বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ সন্ন্যাসী ও জামাই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ মেলায় এসে বেচাকেনা করেছেন। শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ মেলা উপভোগ করেছেন। বিক্রি হয়েছে বিভিন্ন রকম মাছ ও মিষ্টিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে এ মেলার প্রধান আকর্ষণ বাগাড় মাছ কেনাবেচা হয়নি।

বুধবার দুপুরে গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ী বন্দর সংলগ্ন মাঠে মেলা প্রাঙ্গণে দেখা গেছে, বিভিন্ন বয়সের মানুষের উপচে পড়া ভিড়। মেলায় বড় বড় চিতল, ভেউস, বোয়াল, রুই, কাতলা, ব্লাক কার্প, সিলভার কার্পসহ নানা প্রজাতির মাছ বিক্রি হয়। আকার ও ওজনভেদে কাতল ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা, বোয়াল ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা, চিতল ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা, ব্রিগেড ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা, সিলভার কার্প ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, গ্রাস কার্প ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, পাঙাশ ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা, রুই ৪০০ থেকে ১০০০ টাকা, ব্লাক কার্প ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং আইড় ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

টাঙ্গাইলের শরিফ তালুকদার নামে এক ব্যবসায়ী কক্সবাজার থেকে প্রায় ৪০ কেজি ওজনের একটি পাখি মাছ এনেছিলেন। তিনি প্রতি কেজি ১৫০০ টাকা দাম হাঁকেন। শরিফ দাবি করেন, এটি মেলার সেরা মাছ।

বগুড়ার গাবতলীর পীরগাছা এলাকার অনীক মিষ্টি ভান্ডারের মহিদুল ইসলাম জানান, তিনি ১১ কেজি ওজনের ‘মাছ মিষ্টি’নামে বিশেষ মিষ্টি বিক্রি করেন ৪০০ টাকা কেজি দরে। মেলায় ২০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরের কয়েক মণ মিষ্টি বিক্রি হবে। এ ছাড়া কাঠ ও স্টিলের আসবাবপত্র, কৃষি সামগ্রী, গোশত, হরেক রকম আচার বিক্রি হয়েছে। শিশুদের খেলনা ছাড়াও চিত্তবিনোদনের জন্য সার্কাস, জাদু, নৌকা ও নাগরদোলা ছিল।

মেলায় এসেছে বড় বড় চিতল, বোয়াল, রুই, কাতলাসহ নানা প্রজাতির মাছস্থানীয় প্রবীণরা জানান, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রায় ২০০ বছর ধরে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ী বন্দর সংলগ্ন ইছামতি নদীর তীরে সন্ন্যাসী পূজা করে আসছেন। এ উপলক্ষে বাংলা সালের মাঘের শেষ বা ফাল্গুনের প্রথম বুধবার মেলা আয়োজন করা হয়ে থাকে। এখানে লাখ লাখ টাকার মাছ, মিষ্টি, আসবাসপত্রসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ একদিনের মেলায় কেনাকাটা করতে আসেন। এদিকে, পোড়াদহ মেলার সময় আত্মীয় দাওয়াত করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। মেলাকে ঘিরে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের বাড়িতে মেয়ে, জামাই ও নাতি-নাতনিরা এসেছেন। তাদের মেলার মাছ, মাংস, কাঁচা শাকসবজিসহ বিভিন্ন খাবার দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি হরেক রকম পিঠাও রয়েছে। মেলা থেকে অনেক জামাইরা সাধ্যমতো মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে ফেরেন।

মেলায় আগত সিরাজগঞ্জ সদরের ব্যবসায়ী মোকছেদ আলী জানান, তারা চার-পাঁচ বন্ধু পোড়াদহ মেলায় এসেছেন। দিনভর খাওয়া-দাওয়া শেষে বড় মাছ কিনে বাড়িতে ফিরবেন। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে আসা ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ জানান, তিনি পোড়াদহ মেলার আগে স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এলাকার শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন। তিনি শ্বশুরবাড়ির জন্য ১২ কেজি ওজনের বড় সিলভার কার্প মাছ কিনেছেন। বগুড়া শহর থেকে আসা গণমাধ্যমকর্মী আলমগীর হোসেন, ব্যাংকার মিজানুর রহমান, এনজিওকর্মী সুজন সাকিদার জানান, তারা প্রতিবছর পোড়াদহ মেলার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। তারা বড় বড় মাছ, মিষ্টি, হরেক রকম আচার দেখতে ও খেতে আসেন।

মেলা একদিনের হলেও এর আমেজ থাকে সপ্তাহজুড়ে। মেলাটি মহিষাবান গ্রামের মণ্ডল পরিবার পরিচালনা করে আসছে। এবার মেলার নেতৃত্বে ছিলেন মহিষাবান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ মণ্ডল। তিনি জানান, প্রশাসনসহ এলাকাবাসীর সহযোগিতায় শান্তিপূর্ণভাবে মেলা সম্পন্ন হয়েছে।

গাবতলী থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার সকালে গোলাবাড়ী বাজার এলাকায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জাহিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে বউ মেলা অনুষ্ঠিত হবে। এ মেলায় পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ থাকায় বিভিন্ন বয়সের নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করে থাকেন। প্রায় ২৪ বছর ধরে বউ মেলা হয়ে আসছে।