‘ঘরে নিথর অবস্থায় পড়ে ছিল পাঁচ জন’

মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় ঝড়ে বসতঘরের ওপর বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে একই পরিবারের তিন শিশুসহ পাঁচ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় ওই এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. ইমদাদুল ইসলাম চৌধুরী মাসুম বলেন, ‘ফজরের নামাজের পর আমি বাড়ির বারান্দায় ছিলাম। ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে প্রচণ্ড শব্দ শোনা যায়। আমার ভাই ও বাচ্চাদের নিয়ে দৌড়ে যাই শব্দের উৎস লক্ষ করে। গিয়ে দেখি, ফয়জুর রহমানের টিনের ঘরের একপাশে বিদ্যুতের লাইন ছিঁড়ে পড়ে আগুন লেগেছে। দ্রুত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে ফোন দিয়ে জানাই। ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দিই। স্থানীয়দের সহায়তায় ছয় জনকে উদ্ধার করি। ঘরে পাঁচ জন পুরোপুরি নিথর অবস্থায় পড়ে ছিল। একটি মেয়েশিশুর কিছুটা নড়াচড়া দেখি। দ্রুত শিশুটিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।’

প্রতিবেশী জালাল আহমদ বলেন, ‘ভোরে প্রচণ্ড শব্দ শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে আসি। তখনও চিন্তা করিনি, এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখতে হবে। আমরা বাকরুদ্ধ।’

স্থানীয়রা জানান, পরিবারটি জুড়ী উপজেলার পূর্ব জুড়ী ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা। বর্তমানে গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নে বসবাস করতো। বাক প্রতিবন্ধী ফয়জুর রহমান ভ্যানগাড়ির চালক ছিলেন এবং স্থানীয় বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরীর কাজ করতেন। তার এক বোন ও এক ভাইও বাক প্রতিবন্ধী। এলাকায় ফয়জুর রহমান সবার অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অভাবের সংসারে তার ওপরই নির্ভরশীল ছিল পুরো পরিবার।

প্রতিবেশী সোহান ইসলাম, আব্দুর রহিম বলেন, ‘ফয়জুরের ছেলে সায়েম উদ্দিন দুই দিন আগে আমাদের বাড়িতে এসে ঈদের নতুন জামা কেনার কথা বলেছিল। তার দরিদ্র বাবা না কিনে দিলে আমি দেবো বলে তাকে কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই সায়েম পরিবারের আরও চার সদস্যের সঙ্গে পরপারে চলে গেছে। তাদের এমন মৃত্যু সইবার মতো নয়। আল্লাহর কাছে মৃতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।’

পূর্ব জুড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম মঈন বলেন, ‘ফয়জুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যরা অত্যন্ত সহজ-সরল ছিলেন। অভাব থাকলেও তার মধ্যে ছিল সততা। গতকালও তার সঙ্গে কথা হয়েছে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তার ঘরে বিদ্যুতের লাইন আসবে কবে। নিজের ঘরে বিদ্যুৎ না থাকলেও বিদ্যুতের লাইন ছিঁড়ে সে সপরিবারে মারা গেছে।’

গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘কোনও কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। এমন মর্মান্তিক ঘটনা এলাকায় এই প্রথম হয়েছে।’

জুড়ী উপজেলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন পরিদর্শক এস এম শামীম বলেন, ‘খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। আমরা পৌঁছানোর আগেই স্থানীয়রা মরদেহ ও আহতদের ঘরের বাইরে নিয়ে আসেন। বিদ্যুতের মূল লাইন ছিঁড়ে ঘরের ওপর পড়ার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে।’

পুলিশ ও প্রতক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) ভোরে ফয়জুর রহমানের ঘরের টিনের চালে আগুন দেখতে পান স্থানীয়রা। রাতে প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল। ভোরে বিদ্যুৎ আসার পরপরই ঝড় শুরু হয়। এ ঝড়ে বিদ্যুতের ১১ হাজার ভোল্টের মূল তার ছিঁড়ে ফয়জুর রহমানের ঘরের ওপর পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে যায়। ঘরে থাকা লোকজন তাড়াহুড়া বের হওয়ার চেষ্টা করেও পারেননি। স্থানীয়রা পাঁচ জনকে মৃত ও একজনকে আহত অবস্থায় ঘরের মূল দরজার সামনে থেকে উদ্ধার করেন। এ সময় মানুষের আহাজারিতে এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে।

মৃত পাঁচ হলেন- ফয়জুর রহমান (৫২), তার স্ত্রী শিরি বেগম (৪৫), মেয়ে সামিয়া বেগম (১৬) ও সাবিনা বেগম (১৩), ছেলে সায়েম উদ্দিন (৮)।

মৃতদের জানাজার নামাজ মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় স্থানীয় হাজী ইন্তাজ আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হয়েছে। এরপর গোয়ালবাড়ি কবরস্থানে এক সারিতে পাঁচ জনকে সমাহিত করা হয়।

জানতে চাইলে মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বড়লেখা জোনাল কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. সোহেল রানা চৌধুরী বলেন, ‘রাতে ঝড়-বৃষ্টি হওয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। শেষ রাতের দিকে ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলে পুনরায় বিদ্যুৎ সচল করা হয়। এরই মধ্যে পুনরায় ঝড় শুরু হলে ১১ হাজার ভোল্টের মূল লাইন ছিঁড়ে পড়ে। খবর পেয়ে আমরা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করি।’

একসঙ্গে পাঁচ জনের মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পুরো ঘরটি টিন দিয়ে তৈরি, এমনকি দরজাও টিনের। ফলে পুরো ঘর বিদ্যুতায়িত হয়ে যায়। এ অবস্থায় ঘরের বাসিন্দারা হয়তো তাড়াহুড়া করে বের হতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে। খবর পেয়ে আমাদের জেনারেল ম্যানেজারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।’