‘এভাবে স্বামী পরপারে চলে যাবে ভাবতেও পারিনি’

‘আমাদের এভাবে অকূলপাথারে রেখে আমার স্বামী পরপারে চলে যাবে, কোনোদিন ভাবতেও পারিনি। তার অবর্তমানে ছেলে-মেয়েদের কীভাবে বড় করবো?’ কথাগুলো বলছিলেন সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাকার বনশ্রীতে সংঘর্ষে নিহত পিবিআই পরিদর্শক মাসুদ রানার স্ত্রী মেরিনা আক্তার বিনা।

গত ১৮ জুলাই সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হন মাসুদ রানা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ওইদিনই ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের কালান্দর গ্রামে তাকে দাফন করা হয়।

কালান্দর গ্রামের মরহুম আব্দুল জব্বারের আট সন্তানের একজন মাসুদ রানা। স্নাতক পাস করে ১৯৯৮ সালে এসআই হিসেবে পুলিশে যোগদান করেন। ২০০২ সালে একই এলাকার মেরিনা আক্তার বিনার সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তাদের ঘরে রয়েছে দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে উম্মে মাইসা স্নেহা চলতি বছর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। ছোট মেয়ে উম্মে মাহিরা নেহা চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। ছেলে আহনাফ মাহিন ভূঁইয়া অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে।

মেরিনা আক্তার জানান, ‘এসআই থেকে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হয় মাসুদ রানা। গত দুই বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ পিবিআই কার্যালয়ে কর্মরত ছিল। এর মাঝে আমরা ঢাকায় ভাড়া বাসায় ছিলাম। ছেলেমেয়েদের ঢাকায় ভর্তি করাতে হয়েছে। পরে নগদ কিছু জমানো টাকা, ঘরের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে এবং ব্যাংক থেকে ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছি। প্রতি মাসে ব্যাংকে কিস্তি দিতে হয়। আমার স্বামীর মাসিক বেতনের আয় দিয়ে আমাদের সংসার চলতো, পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ মা এবং ভাইদের খরচ দিতে হতো। আমার ছোট মেয়েটা এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। আন্দোলনের কারণে পরীক্ষাও বন্ধ আছে। এখন কীভাবে কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সহযোগিতা হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা আমাদের দিয়েছে। কিন্তু এই টাকা দিয়ে কী হবে? আমার স্বামী অকালে ঝরে গেছে। ছেলেমেয়েরা আর বাবা বলে ডাকতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের পরিবারের প্রতি নজর দেবেন এটিই আমার প্রত্যাশা।’

মেয়ে উম্মে মাহিরা নেহা বলে, ‘আমার বাবার ইচ্ছা ছিল আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবে। এরই মাঝে এইচএসসির সাতটা পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বাকি আছে আরও ছয়টি। আমি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। যারা আমার বাবাকে হত্যা করেছে তাদের দ্রুত বিচার দেখতে চাই।’

মাসুদ রানার বড় ভাই শোয়েব ভুঁইয়া বলেন, ‘আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে মাসুদ রানা ছিল সবচেয়ে মেধাবী। প্রথমবারের চেষ্টাতেই সে পুলিশে এসআই হিসেবে যোগদান করে। সে খুব সহজ-সরল প্রকৃতির ছিল। তার আয়ে আমাদের পরিবার চলতো। আমার বৃদ্ধ মায়ের ওষুধসহ অন্যান্য খরচ প্রতি মাসেই পাঠাতো। এখন তার ছেলেমেয়ে কীভাবে মানুষ হবে সংসার কীভাবে চলবে, এ নিয়ে আমাদের পরিবারের সবাই চিন্তিত। তবে আমরা চাই, যারা তাকে হত্যা করেছে তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়।’

গত ২৩ জুলাই খিলগাঁও থানায় মাসুদ রানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার একটি মামলা দায়ের করা হয়। স্ত্রী মেরিনা আক্তার বিনা বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এতে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।

এদিকে, ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মাছুম আহমেদ ভূঁইয়া জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে নিহত প্রত্যেক পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা সহায়তা করা হয়েছে। পরিবারের সহযোগিতার জন্য সরকার ব্যবস্থা নেবে। পুলিশ নিহত এসব পরিবারের পাশে সব সময় থাকবে।