হামলার অভিযোগে নার্সদের কর্মবিরতি, সাড়ে ৩ ঘণ্টা সেবাবঞ্চিত শত শত রোগী

২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত এক সিনিয়র স্টাফ নার্স ও রোগীর স্বজনদের ওপর হামলার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উঠেছে। হামলার প্রতিবাদ ও হামলাকারীকে গ্রেফতারের দাবিতে কর্মবিরতি ঘোষণা করে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা রোগীদের চিকিৎসাসেবা বন্ধ রাখেন হাসপাতালটিতে কর্মরত নার্সরা। সোমবার (২১ অক্টোবর) সকাল ১১টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এ কর্মবিরতি চলে। এতে সেবাবঞ্চিত হয়ে রোগকষ্টে ভোগেন হাসপাতালে আসা শত শত রোগী।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযুক্ত যুবকের দুই স্বজনসহ তিন জনকে আটক করে থানায় নেয়। তবে ওই যুবককে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত দায়িত্বে ফিরতে অস্বীকৃতি জানান আন্দোলনরত নার্সরা। একজন রোগীর স্বজনের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তুলে শত শত রোগীর ভোগান্তি সৃষ্টি নিয়ে নার্সদের কোনও ভ্রুক্ষেপ দেখা যায়নি।

হামলায় আহত সিনিয়র স্টাফ নার্সের নাম হাবিবুল্লাহ হিরা। আর অভিযুক্ত যুবকের নাম জুয়েল আহমেদ। তিনি কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার কলেজপাড়া তালতলা গ্রামের আরশাদের ছেলে।

ঘটনার খবর পেয়ে সোমবার দুপুরে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, হামলার শিকার সিনিয়র স্টাফ নার্স হাবিবুল্লাহ হিরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার শরীরে স্যালাইন চলছে। অভিযুক্ত জুয়েলের বাবা আরশাদ জরুরি বিভাগে বসে আসেন। তাকে জটলা করে ঘিরে রেখেছেন হাসপাতালের নার্স-কর্মচারী ও পুলিশ। মেঝেতে বসে আছেন অভিযুক্ত জুয়েলের মা জবা বেগম। তার পরনের কাপড় ছেঁড়া। বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল তাকে। বাইরে তাদের কয়েকজন স্বজন কান্নাকাটি করছিলেন।

অন্যদিকে নার্সদের কর্মবিরতিতে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছুটছিলেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের রুমও বন্ধ। ওয়ার্ডগুলোতে ভর্তি রোগীরা সেবাবঞ্চিত। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছিলেন শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের অভিভাবকরা। নার্সদের অনুপস্থিতিতে অনেককে বাধ্য হয়ে নিজ হাতে চিকিৎসাযন্ত্র ব্যবহার করতেও দেখা গেছে।

আন্দোলনরত নার্সরা জানান, সকালে জরুরি বিভাগে রোগী নিয়ে আসেন জুয়েল। টিকিটের জন্য সিরিয়ালে না দাঁড়িয়ে তিনি রুমে ঢুকে পড়েন। তাকে কেন আগে টিকিট দেওয়া হচ্ছে না প্রশ্ন তুলে দায়িত্বরত সিনিয়র স্টাফ নার্স হাবিবুল্লাহ হিরার ওপর হামলা করেন। এর প্রতিবাদে সব নার্স কর্মবিরতি ঘোষণা করেন। অভিযুক্ত জুয়েলকে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে।

সোমবার দুপুরে হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স নীলুফা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের কর্মবিরতি চলবে। যে ছেলে আমাদের ছেলেকে (নার্সকে) মারছে তাকে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত আমরা কাজে ফিরবো না। এভাবে প্রায়ই রোগীর স্বজনদের হামলার শিকার হতে হয়। আমাদের কোনও নিরাপত্তা নেই। এভাবে চলতে পারে না। মানুষের সেবা দিতে এসে মার খেতে পারবো না।’

অভিযুক্ত জুয়েল পলাতক থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তার বাবা আরশাদ ও মা জবার দাবি, জুয়েলের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা থামাতে আরশাদ এগিয়ে গেলে নার্স হিরা তার শার্টের কলার ধরেন। এটা দেখে জুয়েল হিরার ওপর চড়াও হন। ঘটনার পর নার্সরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের ওপর হামলা করেন। এতে জবা বেগম ও তার মেয়ে আহত হন। জবা বেগমের কাপড় ছিঁড়ে যায়।

আরশাদ বলেন, ‘ওদের দুই জনের কথা কাটাকাটির সময় আমি থামানোর চেষ্টা করি। নার্সকে চেয়ারে বসতে বলি। সে উল্টো আমার শার্টের কলার ধরে ধাক্কা দেয়। আমার শার্ট ছিঁড়ে যায়। পরে তারা আমার পরিবারের নারীদের মারধর করে।’

অচলাবস্থা দূর করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নার্সদের শান্ত করার চেষ্টা করে। দায়িত্বে ফেরার জন্য অনুরোধ করে। অভিযুক্ত জুয়েল পলাতক থাকলেও পুলিশ হাসপাতাল চত্বরে থাকা জুয়েলের বাবা আরশাদ ও মা জবা আক্তারসহ তিন জনকে আটক করে থানায় নেয়।

পরে হাসপাতাল পরিদর্শনে যাওয়া রংপুর বিভাগীর পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. হারুন অর রশীদ এবং হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক ডা. শহিদুল্লাহ লিংকন সঙ্গে বৈঠকে বসেন নার্সদের নেতৃবৃন্দ। সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও ডেকে নেওয়া হয়। অভিযুক্ত যুবককে গ্রেফতারসহ নার্সদের নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাসের পর দায়িত্বে ফেরার ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা।

বিভাগীর পরিচালক ডা. মো. হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমরা অভিযুক্তকে গ্রেফতারের জন্য বলেছি। পুলিশ ও সেনাবাহিনী হাসপাতাল এলাকায় টহল জোরদারের আশ্বাস দিয়েছে। এ ছাড়াও হাসপাতাল চত্বরে আনসার মোতায়েনের জন্য কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। নার্সরা দায়িত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’

হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার ও সিনিয়র স্টাফ নার্স রোকেয়া বেগম বলেন, ‘অভিযুক্ত যুবককে গ্রেফতার এবং সমস্যা সমাধানে স্যারদের আশ্বাসের ভিত্তিতে আমরা আপাতত কাজে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ তবে এক রোগীর স্বজনের জন্য শত শত রোগীর ভোগান্তির দায় প্রশ্নে তিনি কোনও সদুত্তর দেননি।

পরে দুপুর আড়াইটার পর তারা কাজে যোগ দেন বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।