বরিশালে দুই শতাধিক বিদ্যালয় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, পাঠদান ব্যাহত

বাকেরগঞ্জের জরাজীর্ণ ২২নং চর দাড়িয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের বাইরে চলছে শিশু শিক্ষার্থীদের ক্লাস

বরিশালে বছরের পর বছর ধরে দুই শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস করছে শিশু শিক্ষার্থীরা। প্রায়ই এ সব বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের প্লাস্টার এবং ঢালাইয়ের বড় বড় খণ্ড খসে পড়ে শিক্ষার্থী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে যে সব স্কুলের শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করা একেবারেই সম্ভব না, সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চলছে খোলা আকাশের নিচে। বৃষ্টির দিনগুলোতে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ে বিপাকে। বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা বলছেন- ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি বারবার জানানো হলেও ভবনগুলো সংস্কার বা নতুন ভবন নির্মাণে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

বাকেরগঞ্জ উপজেলার ২২নং চর দাড়িয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির বয়স ৩৫ বছরের বেশি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- চার কক্ষ বিশিষ্ট জরাজীর্ণ বিদ্যালয় ভবনের পিলারগুলো থেকে ঢালাই খসে রড খুলে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিদ্যালয়ের ছাদ যেকোনও সময় ধসে পড়ার অবস্থায় রয়েছে। প্রতিনিয়ত এ ছাদ থেকে প্লাস্টার ও ঢালাইয়ের বড় বড় খণ্ড শিক্ষার্থীদের শরীরে পড়ছে। এতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। যেকোনও সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। তবু এ অবস্থার মধ্যেই চলছে শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণির ২৬৩ জন শিক্ষার্থীর লেখাপড়া।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহান জানান, শিশু শিক্ষার্থী ধরে রাখতে বিদ্যালয় ভবনটির সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট একাধিক দফতরে বারবার আবেদন-নিবেদন করেও কোনও সাড়া মেলেনি।

বাকেরগঞ্জ উপজেলার ৪নং দুধল ইউনিয়নের ৩৮নং পিলখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কক্ষে ছাদের প্লাস্টার খসে পড়েএদিকে গত বুধবার একই উপজেলার ৪নং দুধল ইউনিয়নের ৩৮নং পিলখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস চলাকালে আকস্মিকভাবে গ্রন্থাগার কক্ষের গ্রেড বিমের ঢালাই ভেঙে পড়ে। এতে অল্পের জন্য রক্ষা পান শিক্ষকরা। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মাহাতাব উদ্দিন খান ও প্রধান শিক্ষিকা অর্পনা রায় বলেন, ১৯৯৮ সালে স্কুল ভবনটি নির্মাণ করা হলেও ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত প্লাস্টার ও ঢালাই খসে পড়ছে। যেকোনও সময় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। বিদ্যালয় ভবনের সংস্কারের বিষয়টি শিক্ষা কর্মকর্তাদের বারবার অবহিত করা হলেও তাতে সাড়া মেলেনি বলে জানান তারা।

আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের ২নং দক্ষিণ শিহিপাশা (দাসেরহাট) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা আরও খারাপ। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন জানান, ১৯৪০ সালে তিন কক্ষের টিনশেড বিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে। পরে দুটি কক্ষে টিন ও একটি কক্ষে ছাদ ঢালাই হলেও বর্তমানে টিনগুলো মরিচা পড়ে প্রায় শেষ, আর সেই ছাদ ভেঙে এখন একাকার। ৭৯ বছরের পুরাতন ভবনের দেয়াল ধসে পড়ার পরও ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবনটিতেই চলছে শিশু শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া।

তিনি আরও জানান, গেল বর্ষায় ওই ভবনের ছাদ দিয়ে পানি পড়ায় শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে পারেনি। আগামী বর্ষায় ভবনটি সম্পূর্ণ ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে একটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চলছে। শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে সকালে প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম এবং দুপুরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১৩৩ জন শিক্ষার্থী ও ৫ জন শিক্ষক রয়েছেন।

আগৈলঝাড়ায় দক্ষিণ শিহিপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধসে পড়া দেয়ালআগৈলঝাড়া উপজেলার অনেকগুলো বিদ্যালয় ভবনেরও জরাজীর্ণ অবস্থা। এসব বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই চলছে শিশু শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া।

শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সিরাজুল হক তালুকদার জানান, উত্তর শিহিপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পুর্ব সুজনকাঠী, সেরাল, পূর্বসুজনকাঠী আইডিয়াল, পশ্চিম সুজনকাঠী, নাঘিরপাড়, দাসপট্টি, রাংতা, পূর্ব আস্কর, বাগধা, পয়সা, পশ্চিম আমবৌলা, ফেনাবাড়ি, চক্রবাড়ি ও তালতারমাঠ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ১৫টি বিদ্যালয় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও ১৩টি বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণসহ মোট ২৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিদ্যালয়গুলো চিহ্নিত করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা ও উপজেলা প্রকৌশল বিভাগ থেকে জেলা দফতরকে অবহিত করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশালের বিভিন্ন উপজেলার দুই শতাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। জরাজীর্ণ এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খোলা আকাশের নিচ থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের পাশের বিভিন্ন স্থাপনায় ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। যেসব বিদ্যালয়ের আশপাশে স্থাপনা নেই, সে সব বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষকরা। এতে প্রাণহানির আশঙ্কার পাশাপাশি লেখাপড়ার পরিবেশ পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। যে কারণে প্রতি বছর ওই সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

৪নং দুধল ইউনিয়নের ৩৮নং পিলখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জরাজীর্ণ ভবনে চলে পাঠদানএকাধিক অভিভাবক জানান, ভবন ধসে যেকোনও সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকায় অনেকেই নিজ সন্তানদের ঠিকমতো বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন না। আবার অনেকে সন্তানকে নিয়ে এসে ক্লাস শেষে আবার বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন।

বিদ্যালয়গুলোর একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেদিন ছুটির সময় পার হওয়ার পরও ক্লাস চলে, সেদিন অভিভাবকরা ফোন করে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে কিনা তা জানতে চান। সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে সবাই এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। আবার
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও প্রাণহানির শঙ্কার মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন, যা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ব্যাহত করছে।

এ বিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের উপ-পরিচালক এসএম ফারুক জানান, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে জরাজীর্ণ স্কুল ভবনের তথ্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ঢাকা থেকে বরাদ্দ পাওয়া গেলে সংস্কার কাজ শুরু করা হবে। তবে কবে নাগাদ ভবন সংস্কার কিংবা নতুন ভবন নির্মাণ হবে সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট কোনও ধারণা দিতে পারেননি।