বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু রোগী বেশি, বরগুনায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম

পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। কেবল জুনের ১৭ দিনে রোগী পাওয়া গেছে দুই হাজার ১২১ জন, আর মারা গেছেন সাত জন। মে মাসের তুলনায় এই সংখ্যা কিছুটা বেশি। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩০ জনের এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ছয় হাজার ৪৬৬ জন। এর মধ্যে রোগী বেশি বরিশাল বিভাগে। এদের বেশিরভাগই বরগুনার। ইতিমধ্যে সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ঢল নেমেছে। তাদের চিকিৎসা দিতে একপ্রকার হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, মে মাস থেকে ডেঙ্গুর হার বাড়তে শুরু করে। মে মাসে এক হাজার ৭৭৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। আর মারা গেছেন সাত জন। এর আগে জানুয়ারিতে এক হাজার ১৬১, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একইসঙ্গে জানুয়ারিতে ১০, ফেব্রুয়ারিতে তিন, এপ্রিলে সাত, মে মাসে তিন জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

৪৪ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী বরিশালে

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকেই ঢাকার বাইরে বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা গেছে। এ বছর এখন পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর মধ্যে দুই হাজার ৮৪২ জন পাওয়া গেছে বরিশাল বিভাগে সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে, যা মোট রোগীর প্রায় ৪৪ শতাংশ। এ ছাড়া চট্টগ্রামে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯৪৫ জন, ঢাকায় (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৯৩ জন, খুলনায় (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৮১ জন, ময়মনসিংহে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১০৪ জন, রাজশাহীতে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯৮ জন, রংপুরে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২২ জন এবং সিলেটে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পাশাপাশি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৫১৯ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৮৯৭ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। 

চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসার মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এটি প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। এজন্য বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যাতে এডিস মশা কোনোভাবেই বাসা বাঁধতে না পারে। আর বাসা বাঁধলেও সেই আবাসস্থল ধ্বংস করতে পারলে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তারা বলছেন, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বাড়ার প্রধান কারণ।

৪০৪ জন চিকিৎসাধীন

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার (১৮ জুন) পর্যন্ত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৪০৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বুধবার পর্যন্ত মোট চিকিৎসা নিয়েছেন তিন হাজার ৭৫ জন রোগী। এর মধ্যে মারা গেছেন আট জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন দুই হাজার ৬৬০ জন। বাকিরা চিকিৎসাধীন আছেন।

গত ১ জানুয়ারি থেকে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় বরগুনা জেলার মানুষ। সেখানে বুধবার পর্যন্ত এক হাজার ৯০৬ জন আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মারা গেছেন পাঁচ জন। সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৬৬৮ জন। চিকিৎসাধীন আছেন ২৩৩ জন। আক্রান্তের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বরিশাল। এ পর্যন্ত শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪০১ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন তিন জন। সুস্থ হয়েছেন ৩০৭ জন। চিকিৎসাধীন আছেন ৯১ জন। তৃতীয় অবস্থানে থেকে পটুয়াখালীতে আক্রান্ত হয়েছেন ২৭৬ জন। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন ২৪৪ জন। চিকিৎসাধীন আছেন ৩২ জন। চতুর্থ অবস্থানে পিরোজপুরে আক্রান্ত হয়েছেন ১১৯ জন। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন ১১৪ জন। চিকিৎসাধীন আছেন পাঁচ জন। পঞ্চম অবস্থানে ভোলায় ৪২ জন আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ৩৭ জন সুস্থ হয়েছেন। চিকিৎসাধীন আছেন পাঁচ জন। সবচেয়ে কম আক্রান্ত হন ঝালকাঠিতে ৩৩ জন। সুস্থ হয়েছেন ২৯ জন। চিকিৎসাধীন আছেন চার জন। 

আক্রান্ত রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভাগের ছয় জেলা শহর থেকে শুরু করে ৪২টি উপজেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী প্রতিদিন বাড়ছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ গ্রামে বসবাসকারী। বাড়ি সংলগ্ন ঝোপঝাড় এবং অপরিষ্কার জায়গায় এডিস মশা বংশ বিস্তার করেছে। সেখান থেকেই মশার কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসা না পেয়ে তারা শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসছেন। সেখানে মেডিসিন ওয়ার্ডে চলছে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা। এ ছাড়া জেলা হাসপাতালেও চলছে চিকিৎসা।

প্রতিদিন ৫০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন

বরগুনা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ঢল নেমেছে। ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন ৫০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। সরেজমিনে দেখা যায়, পা ফেলার জায়গা নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের জন্য ৫০ শয্যার আয়োজন করেছে। পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে শয্যায় জায়গা না হওয়ায় রোগীদের চিকিৎসা চলছে ওয়ার্ডের মেঝেতে, নার্সদের ডেস্কের পেছনে ও বারান্দায়। 

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আমতলী, বেতাগী, পাথরঘাটা, তালতলী, বামনা ও বরগুনা সদরসহ সবকটি উপজেলায় এবার ডেঙ্গু দেখা দিয়েছে। সদর উপজেলার বাইরে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে পাথরঘাটা উপজেলায়। এই উপজেলায় এ পর্যন্ত ৭৭ জন আক্রান্ত হন। ১০ জন বা তার বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এ রকম ৩৬টি এলাকা চিহ্নিত করেছে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। 

বরগুনা জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. রেজাওয়ানুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিনই রোগী আসছে। চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমরা সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

বরগুনায় রোগী বেশি কেন 

গত কয়েক বছরের সরকারি হিসাব বলছে, জেলাটিতে ডেঙ্গু ছিল। ২০২২ সাল জেলায় ৪৮৫ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এর পরের বছর ২০২৩ সালে ভর্তি হয়েছিলেন চার হাজার ৫৯২ জন, এর মধ্যে মারা যান সাত জন। গত বছর ভর্তি হয়েছিলেন দুই হাজার ৪৩৪ জন, মারা যান চার জন।

জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ বলেন, ‘জেলায় কেন এবার রোগী বেশি, বিষয়টি জানার জন্য আমরা আইইডিসিআরের গবেষকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তারা তিনটি বিষয় দেখবেন—ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে কোনটিতে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, এডিস মশার জিনগত কোনও পরিবর্তন ঘটেছে কিনা এবং কেন বরগুনা হট স্পট।’

যা বলছেন রোগী ও স্বজনরা

বরগুনা থেকে মাকে এনে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন ফাতেমা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে কেউ কোথাও থেকে বেড়াতে আসেনি। তবে বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় আছে। এ ছাড়া বাড়িতে রাতে মশারি ব্যবহার করলেও দিনের বেলায় চলাফেরা করতে হয়। আমার ধারণা বাড়ির পাশের ঝোপঝাড়ে এডিস মশা জন্মেছে। সেখান থেকে মাকে কামড়ে দেওয়ায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন।’ 

বরগুনা জেলা শহরের বাসিন্দা মো. সারোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত কয়েক মাস সিটি করপোরেশনের কর্মী, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বরদের পাচ্ছি না আমরা। এ কারণে মশা নিধনে কোনও ধরনের ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না। যার ফলে মশা বেড়েছে। এর কামড়ে ডেঙ্গু রোগীও বেড়েছে।’ 

শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্কুলছাত্রী মরিয়ম আক্তারের মামা মো. রাসেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নলছিটি উপজেলা থেকে ভাগনিকে এনে এই হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে বড় ধরনের কালো মশার উপদ্রব বেশি। যে স্থানে কামড় দেয় সেটি ফুলে ওঠে এবং চুলকানি শুরু হয়। আমার ধারণা ওই মশার কামড় থেকেই ভাগনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।’

চিকিৎসায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়

শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. এসএম মনিরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকিৎসা দিয়ে কোনোভাবেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনসচেতনতা।’

দুটি কারণে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে উল্লেখ করে ডা. এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এর মধ্যে প্রথমটি হলো মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে না পারা। দ্বিতীয়ত মশার আবাসস্থল ধ্বংস করতে না পারা। আপনি ফুটো নৌকার পানি যতই সেচের ব্যবস্থা করবেন, তা থেকে পানি শেষ করতে পারবেন না। এজন্য প্রয়োজন ফুটো বন্ধ করে দেওয়া। একই রকম মশার আবাসস্থল ধ্বংস করতে হবে। এজন্য চিকিৎসা দিয়ে প্রতিরোধ নয়, আগে বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। কোনও পাত্রে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। বিশেষ করে এডিস মশার উৎপত্তিস্থল শনাক্ত করে ধ্বংস করতে হবে। বর্তমানে ডেঙ্গু বাড়ার মূল কারণ বাড়ির পাশের ঝোপঝাড় এবং পাত্রে স্বচ্ছ পানি রাখা। সেখানে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে কামড়ালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়।’

এ ব্যাপারে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বরিশাল বিভাগে গত বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেড়েছে। আমিও ভাবছি, কেন এই বিভাগে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। বিশেষ করে বরগুনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এর উৎস হচ্ছে জীবাণু বহনকারী রোগী এবং বহনকারী মাধ্যম হচ্ছে এডিস মশা। এজন্য কয়েকটি স্পট পরীক্ষা করে এডিস মশার উৎপত্তিস্থল পাওয়া গেছে। মাধ্যম ও উৎস থাকলে আর এডিস মশা কামড়ালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হবে। এজন্য বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। শৌচাগার থেকে শুরু করে রান্নাঘর এবং বিভিন্ন পাত্র ও ফুলের টবে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। ওই স্থানগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। মোটকথা সচেতনতার বিকল্প নেই। সচেতন হলেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব।’