কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী। এই দ্বীপকে ঘিরে সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলেও পর্যটন শিল্পের জন্য এই দ্বীপ এখনও উন্নয়নের আওতায় আসেনি। অথচ নানা কারণে এই দ্বীপ বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অসংখ্য পর্যটকদের কাছে অতি পরিচিত নাম। আর এই দ্বীপের মূল আকর্ষণ আদিনাথ মন্দির। কিন্তু যথাযথ সংস্কার ও উদ্যোগের অভাবে জৌলুস হারাচ্ছে এই মন্দিরটি।
মহেশখালী পৌর সদর থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার উত্তরে আদিনাথ পাহাড়ে অবস্থিত মৈনাক পর্বত চূড়া নামক স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী তীর্থ মন্দির আদিনাথ। প্রতি বছর বসন্তের শুরুতে এখানে ১০ দিনব্যাপী শিব চতুর্দশী পূজা ও মেলা চলে। এ মেলায় দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পূর্ণার্থী ও দর্শনার্থীদের ভিড় জমে। হয়ে উঠে সার্বজনীন উৎসব।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ধারণা মতে, ৩ হাজার বছর আগে ক্রেতাযুগে এ আদিনাথ মন্দিরের গোড়াপত্তন হয়। এখানে প্রতি বছর শিবমন্দিরে অনুষ্ঠিত প্রায় হাজার বছরের প্রাচীনতম মেলায় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটক ও সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাড়াও বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়।
শিবমন্দিরের পাদদেশে নৈসর্গিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত আদিনাথ মেলায় বিশেষ করে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমারসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তীর্থ যাত্রীদের উপস্থিতিতে ঘটে মহা মিলন মেলা। ব্যতিক্রমধর্মী এ মেলায় রাতের পর রাত গান ও নাটক উপভোগ করেন সব ধর্মের মানুষ।
স্থানীয় সিনিয়র সাংবাদিক মাহবুব রোকন জানান, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মূল আকর্ষণ হচ্ছে মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির। পর্যটন মৌসুম ছাড়াও এই মন্দির দেখতে প্রতিদিন শত শত পর্যটক এখানে এসে ভিড় জমায়। কিন্তু যেভাবে এই মন্দিরকে নিয়ে উন্নয়ন হওয়ার কথা, সেভাবে হয়নি। চলতি বছরে এই মন্দিরে সার্কিট ক্যামেরা, বিশ্রামাগারসহ সামান্য কিছু উন্নয়ন হয়েছে। এই আদিনাথ মন্দিরকে কক্সবাজার মেগা প্রকল্পের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
মহেশখালী আদিনাথ মন্দির সংস্থার কমিটির সভাপতি পূর্ণচন্দ্র দে জানান, মহেশখালী আদিনাথ মন্দির বিশ্বখ্যাত। এই মন্দির দেখতে পর্যটকরা দূর-দূরান্ত থেকে এখানে আসেন। কিন্তু দিন দিন এই মন্দির সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও যথাযত উদ্যোগের অভাবে আকর্ষণ হারাচ্ছে। তাই খুব দ্রুত এই মন্দিরটি সংস্কার করে পর্যটন উন্নয়নে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
কক্সবাজার জেলা পূজা উদযাপন কমিটি সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা জানান, ঐতিহ্যবাহী আদিনাথ পাহাড়ের পাদদেশে বসা এই সার্বজনীন বাঙালির মিলন উৎসব এখন ঐতিহ্য ও প্রাণ চাঞ্চল্য হারাতে বসেছে। একসময় জারি, সারি, ভাটিয়ালীসহ নানা ধরনের গান, পুঁথিপাঠ ও পালা কীর্ত্তন হতো মেলা চত্বরে। তাছাড়া মেলায় নকশা আঁকা রঙিন ঘুড়ির যুদ্ধ হতো। এছাড়া বাঁশের মুরালীর তাল আর সানাই নিয়ে বাজাতে ব্যস্ত থাকত রাখালরা। ইদানিং মেলার সেই জৌলুস এখন আর নেই।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, শুধু আদিনাথ মন্দির নয়, পুরো কক্সবাজারকে পাল্টে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বর্তমান সরকার। সে লক্ষে কাজ হচ্ছে। সরকার যে কটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সেখানে আদিনাথ মন্দিরও সংস্কার হবে। এটিকে আধুনিক মানের পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক জানান, বর্তমান সরকারের অধিকাংশ উন্নয়ন মহেশখালীকে ঘিরে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর, মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। পাশাপাশি আদিনাথ মন্দিরকেও পর্যটনের আওতায় এনে পর্যটন শিল্প বিকাশে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গ, সনাতন সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক তীর্থভূমি আদিনাথ মন্দির। খ্রীষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর পূর্বে এ দ্বীপে সনাতন সম্প্রদায়ের স্বয়ং দেবাদি দেব, মহাদেব প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালিন জনৈক নেপালি রাজা সাড়ে ৩ হাজার বছর আগে আদিনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে মহেশখালী দ্বীপের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান নুর মোহাম্মদ সিকদার আদিনাথের অস্তিত্ব খুঁজে পান। প্রতিরাতে ওই মুসলিম পরিবারের একটি দুগ্ধজাত গাভী সেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দুধ ঢালতেন। একদিন স্বপ্নপ্রাপ্ত হয়ে ওই মুসলিম পরিবারের সন্তান যেখানে দুধ ঢালতেন সেখানে একটি গৃহ নির্মাণ করে দেন। এরপর থেকেই সনাতন সম্প্রদায়ের লোকজন আবিস্কৃত শিব লিঙ্গ সর্ম্পকে বেত পুরানের বর্ণনা মতে আদিনাথ মন্দির রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন। এই খবর তৎকালীন সময়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে মহেশখালী চ্যানেলে তীর ঘেষে ঐতিহাসিক মৈনাক পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়াটি হয়ে ওঠে সনাতন সম্প্রদায়ের মহা তীর্থ স্থানে। পরবর্তী পর্যায়ে এ তীর্থ স্থান সনাতন সম্প্রদায় ছাড়াও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
/এআর/