অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প

রোহিঙ্গা ক্যাম্পবড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। সম্প্রতি ঘুমধুমের ট্রানজিট রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনে চার জনের মৃত্যুর পর এই ঝুঁকি রীতিমত আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। তবে এরই মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফায়ার সার্ভিসের আলাদা ইউনিট গঠনের পাশাপাশি নানা উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন।

উখিয়া ও টেকনাফের বনবিভাগের পাহাড়গুলোয় বাঁশ, বেত ও পলিথিন দিয়ে সারি সারি ঝুপড়ি ঘর তৈরি করা হয়েছে। এসব ঝুপড়িতে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা দেশি চুলায় রান্নার কাজও করে। পলিথিন দিয়ে তৈরি এ ঝুপড়ি ঘর শীত মৌসুমে আগ্নিকাণ্ডের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। হাতে তৈরি চুলার আগুনের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় যেখানে সেখানে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে।

গত দুই মাসে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় ২০টির বেশি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। এসব ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে ১১ জন, আহত হয়েছে অন্তত ৩০ জনের ওপরে। সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি উখিয়ার টিভি কেন্দ্রের পাশে ঘুমধুম এলাকায় অবস্থিত ট্রানজিট ক্যাম্পের তাবুতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মা ও শিশুসহ চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও একজন।

উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের লালু মাঝি (রোহিঙ্গাদের নেতা) বলেন, ‘অস্থায়ীভাবে তৈরি সারি সারি ঘরের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কোনও পরিবারে রান্না করার সময় অসাবধানে যদি আগুন লেগে যায় তাহলে কোথাও পালিয়ে বাঁচার অবস্থা নেই। এত ঘন বসতি! আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এজন্য আমরা আতঙ্কে আছি।’

উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হাবিব উল্লাহ বলেন, ‘আমরা খুবই আতঙ্কে আছি। শীত মৌসুম আসার পর থেকে ছোট বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিন কোনও না কোনও ঝুপড়ি ঘরে আগুন লাগছে। তবে বড় ধরনের বিপদ না হওয়ার আগেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে। বেশিরভাগ আগুনের সূত্রপাত হচ্ছে রান্নাঘর থেকে।’রোহিঙ্গা ক্যাম্প (ছবি: আবদুল আজিজ)

একই ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মর্জিয়া বেগম বলেন, ‘ক্যাম্পে আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনও পানির ব্যবস্থা নেই। এখানে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। কিছুদিন আগেও ঘুমধুমে মোমবাতির আগুন থেকে পুরো ক্যাম্পে আগুন ধরে যায়। এ ঘটনায় মা ও শিশুসহ চার জন মারা যায়। নিজেরা সতর্ক থাকলেও আগুনের ঝুঁকি রয়ে যাচ্ছে।’

উখিয়া ফায়ার সার্ভিসের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অগ্নি নির্বাপক ইউনিটের ইনচার্জ ফরিদ আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো তৈরি করা হয়েছে বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা তাঁবুর ভেতরে রান্না করার কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় যাতায়াতের রাস্তা সংকীর্ণ এবং পানি অপ্রতুল। ফলে কোথাও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে নিয়ন্ত্রণে আনা দুরূহ হয়ে ওঠে।’

উখিয়া ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলে অগ্নিকাণ্ড হলে কিভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা হয় তা অধিকাংশ রোহিঙ্গারা জানে না। এজন্য আমরা রোহিঙ্গাদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করছি। ইতোমধ্যে আমরা বাজার, হাসপাতাল, মসজিদ ও স্কুলগুলোয় রোহিঙ্গা মাঝিদের নিয়ে প্রচারণা শুরু করেছি। রান্নার চুলা বাইরে রাখার পরামর্শসহ বিড়ি, সিগারেটের আগুন থেকে সাবধান থাকার জন্য সতর্ক করছি।’

ফরিদ আহমেদ আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা’র (আইওএম)  সঙ্গে সমন্বয় করে পানির জন্য রিজার্ভ ট্যাংক স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আটটি জোনে ভাগ করে এ কার্যক্রম চলছে। এজন্য প্রত্যেকটি জোনে ১০ হাজার লিটার পানির রিজার্ভ ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিনির্বাপণ সম্ভব হবে।’

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী জানান, উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীতে তিন হাজার একর জমিতে গড়ে ওঠা এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্প ২০টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি ব্লকের জন্য একজন করে ক্যাম্প ইনচার্জ ইতোমধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটি এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১০০ রোহিঙ্গা অগ্নিনির্বাপণকর্মী তৈরি করা হয়েছে। একইভাবে আরও অন্যান্য যন্ত্রপাতি সরবরাহের পরিকল্পনাও রয়েছে।

গত বছরের ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংস ঘটনার পর থেকে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকে রোহিঙ্গারা। এখন পর্যন্ত ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৩০০ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের পর থেকে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়।

এছাড়াও দুই দশকে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। নতুন পুরনো মিলিয়ে কক্সবাজারে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখের ওপরে। এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে মানবিক দৃষ্টিতে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ সরকার। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, লেখাপড়া, বিনোদনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পাসপোর্ট অধিদফতর ১২টি অস্থায়ী কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার নাগরিকদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় ছয়টি ক্যাম্পের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ১০ লাখ ৫২ হাজার ৮৪৩ জনের নিবন্ধন করেছে।