জানা যায়, আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছে বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সাবেক সংসদ ও সাবেক জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কংজরী চৌধুরী ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অধ্যক্ষ সমীর দত্ত চাকমা। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য এসব প্রার্থীরা জেলা সদর ও উপজেলাগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরছেন। নিজেদের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে বক্তব্যও দিচ্ছেন। সম্ভাব্য আওয়ামী প্রার্থীদের এসব তৎপরতায় দলীয় কোন্দলের চাপ সুস্পষ্ট এবং রাজনৈতিক উত্তাপ রয়েছে।
গত ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবসের অনুষ্ঠান খাগড়াছড়িতে দুটি গ্রুপ আলাদাভাবে পালন করেছে। একটি গ্রুপে বর্তমান সংসদ সদস্যসহ জেলা আওয়ামী লীগের সব অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ছিলেন, অন্যগ্রুপে সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশী যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও সমীর দত্ত চাকমা নেতৃত্ব দেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও সমীর দত্ত চাকমা গত কয়েক বছর নিষ্ক্রিয় ভুমিকা পালন করলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সরব হয়েছেন। এই দুজন বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগ হতে বহিষ্কৃত সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল আলমসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল আলম বিগত পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শানে আলমের বিরুদ্ধে তার ছোটভাই রফিকুল আলমের পক্ষে কাজ করেন। এছাড়া দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে জেলা আওয়ামী লীগ হতে বহিষ্কার হন তিনি। তবে এই বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কোনও অনুমোদন ছিল কিনা তা জেলাবাসীর কাছে পরিষ্কার নয়।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক মাঠে সোচ্চার বিএনপি। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী জেলা বিএনপির সভাপতি ও দুবার নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভুইয়া দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে তার প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিএনপি থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সমীরণ দেওয়ান নির্বাচন করবেন এমন খবর পাওয়া গেলেও তিনি প্রকাশ্য কোনও প্রচারণা বা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নেই। এদিকে বিভিন্ন কারণে নির্বাচনে আসা না আসা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছে ইউপিডিএফ।
১৯৭০ সালে তিন পার্বত্য জেলা মিলে একটি আসন ছিল। সেই সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে আসনটিতে জয়লাভ করেন জাসদ (আসম আবদুর রব) প্রার্থী উপেন্দ্র লাল চাকমা, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) প্রার্থী একেএম আলিম উল্ল্যাহ, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কল্প রঞ্জন চাকমা, ২০০১ ও ২০০৬ সালে বিএনপির প্রার্থী ওয়াদুদ ভুইয়া, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা জয়লাভ করেন।
জানা যায়, জাতীয় পার্টি (এরশাদ) এর জেলা পর্যায়ে দলটির সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি সোলায়মান আলম শেঠ মনোনয়ন পান খাগড়াছড়ি আসনে। তখন থেকেই পাল্টে যেতে থাকে জাতীয় পার্টির তৎপরতাও। আগামী নির্বাচনেও সোলায়মান আলম শেঠই দলের মনোনয়ন পাবেন বলে মনে করেন সাধারণ নেতাকর্মীরা।
খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ এর আঞ্চলিক রাজনীতিকে বেশ শক্তিশালী বলে ধরা হত। তবে তাদের এই শক্তিশালী বাহুতে সম্প্রতি ঘুণ ধরেছে বলে অনেক নেতাকর্মী মনে করছেন। রাষ্ট্রদ্রোহ, স্বৈরচার, চাঁদাবাজি, দুর্নীতিসহ অসংখ্য অভিযোগ এনে গত বছরে ইউপিডিএফ'র মূল দল ভেঙে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে অন্য একটি আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হয়। এর পর থেকে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে সংগঠনটি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপরীতে এই দলের প্রধান প্রসিত বিকাশ খীসা অংশ নিয়ে জেলাবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ইউপিডিএফ থেকে নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
সাবেক এমপি যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, ‘খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তেমন কিছু নয়, কেন্দ্র থেকে চাইলেই এটা সমাধান হয়ে যাবে। এখানে আমি সাবেক সংসদ সদস্য ছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ডিজিটাল দেশ গড়তে আমি সর্বদা সচেষ্ট ছিলাম। এ অঞ্চলের উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের সুখে-দুঃখে সবসময় পাশে ছিলাম, এখনও আছি। নেত্রী তার সোর্স দিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনসমর্থন যাচাই করেছেন। এখানে নেত্রী সিদ্বান্ত নিবেন, কে মনোনয়ন পাবেন। তবে আমি আশাবাদী দল এবার আমাকে মনোনয়ন দেবে।’
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কংজরী চৌধুরী বলেন, ‘মনোনয়নের চূড়ান্তের এখতিয়ার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেই। মনোনয়ন যিনিই পাবেন তাঁর পক্ষেই আমরা কাজ করবো। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনটি ধরে রাখাই জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীর উদ্দেশ্য।
সোলায়মান আলম শেঠ বলেন, ‘এরশাদের শাসনামলেই পাহাড়ে বিদ্যুৎ, সড়ক, উপজেলা পরিষদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণসহ ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তাই আগামী নির্বাচনে এসব বিষয়কে সামনে রেখেই মেনোফেস্টো প্রণয়নের কাজ চলছে।’ তিনি নিজের মনোনয়নের বিষয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে বড়ো দুই দলের ধাক্কাধাক্কি এবং আঞ্চলিক দলের চাপাচাপির ফরে লাঙল-ই জয়ী হবে।’
ইউপিডিএফ’র কেন্দ্রীয় প্রচার সেলের প্রধান নিরন চাকমা বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে জন্মের পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই (জাতীয় ও স্থানীয়) আমাদের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু সরকার ও প্রশাসনের চাপে কোনও কর্মসূচি পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল এমনকি নারী কর্মীদেরও ধরপাকড়-মামলায় জড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।’
এছাড়াও খাগড়াছড়িতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), জাসদ (ইনু), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।