ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে ওঠে ফেনীর ভাষা শহীদ সালাম জাদুঘর ও গ্রন্থাগার। চলে তখন পরিচ্ছন্নতা ও সাজসজ্জার কাজ, বেড়ে যায় নানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আনাগোনা। এই সময়ে কিছু দর্শনার্থী দেখতে এলেও জাদুঘরে ভাষা শহীদ সালামের কোনও স্মৃতিচিহ্ন না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান তারা। অন্যদিকে ভাষা শহীদ সালাম জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের ভেতরে সাড়ে তিন হাজার বই থাকলেও স্থাপনের তের বছরেও সেখানে তেমন পাঠকের দেখা মেলেনি।
সরেজমিনে ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়িনের সালাম নগরে গিয়ে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়।
সবচেয়ে বড় বিষয় গ্রন্থাগারের ভেতরে কোথাও ভাষা শহীদ সালামের কোনও স্মৃতিচিহ্ন, এমনকি কোনও ছবিও দেখা যায়নি। তবে ফটকে আবদুস সালামের একটি ছবি রয়েছে।
গ্রন্থাগারিক লুৎফুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জাদুঘরে ভাষা শহীদের একটি ছবি ছাড়া তেমন কোনও স্মৃতিচিহ্ন নেই। পাঠকশূন্য গ্রন্থগার নিয়মিত খোলা রাখা হয়। গ্রামের পরিবেশ বিধায় সারা বছরই অনেকটা পাঠকশূণ্য থাকে। এর পর করোনাকালে এখন তেমন কেউ আসেই না। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি জাদুঘরের পাশে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আসেন। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়।
সালামের স্মৃতিরক্ষায় সালাম জাদুঘর সন্নিকটে মাতুভূঞা এলাকার বেসরকারি সালাম মেমোরিয়াল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কায়েশ রিপন বলেন, কলেজটি সরকারিকরণের উপযোগী পরিবেশ আছে, তাই আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি দাবি জানাই যাতে কলেজটি দ্রুত সরকারিকরণ করা হয়।
শহীদ সালামের ভাই আবদুল করিম সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, সালামের স্মৃতি রক্ষার্থে তার নামে সালাম নগরে প্রতিষ্ঠিত কলেজটি সরকারিকরণসহ একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। যাতে গ্রামের কিশোর-কিশোরীদের প্রাথমিক শিক্ষার পর মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য দূর-দূরান্তে যেতে না হয়।
এছাড়া এখানে একটি পার্ক স্থাপনসহ সালাম জাদুঘরে আরও আধুনিকায়ন করে গড়ে তোলার দাবি জানান স্থানীয়রা। যাতে দেশ ও বিদেশের মানুষ ভাষা শহীদ ও ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে বিস্তিারিত জানতে পারে।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী আবু দাউদ মো. গোলাম মোস্তফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এডিপির অর্থায়নে ১২ শতক জমিতে সাড়ে তেষট্টি লাখ টাকা ব্যয়ে সালামনগরে জাদুঘরটি স্থাপন করা হয়। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ২০০৮ সালের ২৬ মে সালাম স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারটি উদ্বোধন করেন। জেলা পরিষদ এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভাষা শহীদ আবদুল সালামের স্মৃতি এখানে নেই। শুরু থেকেই স্মৃতিচিহ্ন রাখার কোনও পরিকল্পনাও ছিল না। জেলা পরিষদ অস্থায়ী ভিত্তিতে একজন গ্রন্থাগারিক ও একজন পাহারাদার নিয়োগ দিয়েছে। তারা সেখানে কর্মরত রয়েছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বায়ান্নর উত্তাল সময়ে চলমান আন্দোলন টগবগে তরুণ সালামের হৃদয়ও ছুঁয়ে যায়। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ১৪৪ ধারা জারি করলেও তা অগ্রাহ্য করে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনের রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিলে নামে ছাত্র-জনতা। সে মিছিলে অদম্য সাহসে অংশ নেন সালামও। আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে পড়লে মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ গুলিবিদ্ধ হন অনেকে। গুরুতর আহত অবস্থায় আবদুস সালামকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চার দিন চিকিৎসাধীন থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ফেনীর এ সাহসী সন্তান। পরে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে সালামের মৃতদেহ ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়।
আরও পড়ুন:
শ্রদ্ধা জানাতে প্রস্তুত শহীদ মিনার
২১ বরেণ্য ব্যক্তিকে একুশে পদক দিলেন প্রধানমন্ত্রী