‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ সনদের নামে ৫শ’ গ্রামবাসীর সঙ্গে প্রতারণা!

রাঙামাটির লংগদু উপজেলার দুর্গম গ্রাম ভাসান্যাদাম। সড়কপথে নেই এই গ্রামের কোনও যোগাযোগ। জেলা সদর থেকে নৌপথে এই গ্রামে যেতে সময় লাগে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। সহজ সরল এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষেরই প্রধান অবলম্বন কৃষিকাজ ও মাছ শিকার। ২০১৭ সালে এই গ্রামে এসে একটি চক্র এসব সহজ-সরল মানুষকে একাত্তরের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার কথা বলে সনদ প্রতি নিয়েছে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা। চক্রটি প্রত্যন্ত এই গ্রামসহ উপজেলাবাসীকে জানিয়েছিল, সনদটি দিয়ে তারা বীরমুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পাবেন। এভাবে তারা হাতিয়ে নেয় অন্তত অর্ধ কোটি টাকা। চার বছর পার হওয়ার পর এসব সরল গ্রামবাসী বুঝতে পেরেছেন এই সনদের কোনও মূল্য নেই, তারা প্রতারিত হয়েছেন। এখন এই চক্রটিকে খুঁজে বের করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন তারা।

জানা গেছে, সরকারি ভাতা ও সন্তানদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়েই টাকার বিনিময়ে একাত্তরের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার সনদ বিতরণ করতে এই প্রত্যন্ত গ্রামটিতে এসেছিল ওই চক্রটি। তাদের সঙ্গে দ্রুতই যোগ দেয় স্থানীয় আরেকটি চক্র। তাদের এই সুবিধা ওই সুবিধার গল্পে গ্রামের সবচেয়ে সাবধানী মানুষটারও সন্দেহের পাশাপাশি লোভ জাগতে থাকে। নানা প্রশ্ন করে তারা। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সুবিধার প্রতিশ্রুতিতে একজন দুইজন করে সাড়া দিতে থাকায় বাকিরাও আর খুঁজে দেখেনি আদৌ এটা সত্যি কিনা।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই চিত্র শুধুমাত্র এই গ্রামেরই নয়; পুরো উপজেলাজুড়েই। সহজ সরল এসব মানুষকে এভাবে বোকা বানিয়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে কথিত একাত্তরের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার সনদ হাতে ধরিয়ে দিয়ে সটকে পড়েছে এই চক্রটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলায় এই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন পাঁচ শতাধিক সাধারণ মানুষ।

চার বছর আগে এই সনদ দেওয়ার নামে প্রত্যেক গ্রামবাসীর কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা নিয়েছিল প্রতারক চক্রটি।

স্থানীয় মোবারক হোসেন বলেন, আমার বাবা ও মা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিল। তখন স্থানীয় বাবুল মিয়া আমার বাবাকে বলে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের সরকার ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেবে। তার জন্য সনদ পত্র ও আইডি কার্ডের জন্য খরচ করতে হবে। এভাবে তাকে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত আর কোনও সুবিধা আমরা পাইনি।

ভাসান্যাদম ইউনিয়নের ঘনমোড় গ্রামের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম বলেন, ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে বলে আমাদের কাছ থেকে টাকা চাইলে আমি আমার দুইটি ছাগল বিক্রি করে টাকা দেই। কিন্তু, আর তাদের কোনও খোঁজখবর পাচ্ছি না। এখনও পর্যন্ত কোনও সুযোগ সুবিধা পাইনি।

একই গ্রামের আরেক বাসিন্দা আব্দুল খালেক বলেন, তিন ধাপে ১৫ হাজার টাকা দিছি, তারা শুধু সনদ পত্র ও আইডি কার্ড দিছে। আর কোনও সুবিধা পাইনি। তারা বলেছিল, ভাতা দেবে তাও পাচ্ছি না। তাদেরও খোঁজখবর নাই।

পুরো উপজেলায় যখন এই চক্রটি এই মিথ্যে সনদের নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছিল তখন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান, মেম্বার কিংবা উপজেলা প্রশাসনের কোনও কর্মকর্তা কেন এ বিষয়টি টের পেলেন না নাকি জেনেও না জানার ভান করেছেন তা নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।

সনদটি যত্ন করে আগলে রেখেছেন এই বৃদ্ধ। ভেবেছিলেন সত্যিই পাবেন এই সনদের বরাতে সরকারি সুবিধা।

তবে এতদিনে বিষয়টি এভাবে চাউর হওয়ায় এখন তবে সনদ পাওয়ার পর ভাতা না পাওয়ায় খোঁজ নিতে গিয়ে এসব মানুষ জানতে পারেন, প্রতারিত হয়েছেন তারা। এই ধরনের ঘটনা নিয়ে বিব্রত স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি জেনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।

রাঙামাটি লংগদু মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মীর শাহ নেওয়াজ চৌধুরী বলেন, এই ধরনের কথা আমরা শুনেছি, যারা এধরনের কাজ করছে সেই চক্রটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাই।

রাঙামাটি লংগদু, ভাসান্যাদম ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড মেম্বার আমির হোসেন বলেন, টাকা দেওয়ার আগে আমাদের সাথে পরামর্শ করলে হয়তো এভাবে প্রতারিত হতে হতো না।

সবার হতে ‘৭১-এর সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার সনদ। অথচ এই কাগজটির নেই ছিটেফোটাও দাম।

তবে সেসময়ে বিষয়টা তিনি জেনেছিলেন কিনা এবং নিজে থেকে এজন্য কোনও উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান তিনি।

লংগদু উপজেলা একাত্তরের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ সভাপতি মো. মোস্তফা কামাল টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমাদের কার্যক্রম গত দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।

রাঙামাটি লংগদু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাইনুল আবেদিন বলেন, সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার সনদের জন্য কোনও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি, লিখিত অভিযোগ পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।