কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরা বন্ধ: জেলেপল্লিতে হাহাকার

প্রতি বছরের মতো এবারও ১ মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। ফলে বেকায়দায় পড়েছেন খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার জেলেরা। এখনও এক মাস শেষ হয়নি, কিন্তু হাহাকার শুরু হয়েছে জেলেপল্লিগুলোতে।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) মহালছড়ি উপ-কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলা ঘিরেই রয়েছে কাপ্তাই লেক। মহালছড়ি উপজেলার অভ্যন্তরে সরকারিভাবে নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন এক হাজার ৫৯১ জন। ২০১৪ সালে সরকারিভাবে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয় তাদের। তবে অনেক চেষ্টা তদবিরের পর ২০১৯ সাল থেকে তারা রেশন পাচ্ছেন। এ বছরও সব জেলেকে প্রতি মাসে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। এছাড়া সরকারের আর্থিক সহযোগিতাসহ আর অন্য কোনও ধরনের সহযোগিতা থাকলে তাও পাবেন জেলেরা।

মহালছড়ি মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি মো. ফরিদ মিয়া বলেন, ‘২০১৬ সালে সরকারিভাবে এক হাজার ৫৯১ জন জেলের নিবন্ধন করা হয়। বর্তমানে এই সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। গত ৫ বছরেও কোনও জরিপ হয়নি। ফলে নিবন্ধনের আওতায় আসেনি বেশিরভাগ জেলে। প্রতি বছরই জেলের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু জরিপ না থাকায় প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠছে না। প্রতি বছর তিন মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে, অথচ রেশন দেওয়া হয় মাত্র দুই মাস। তাও কেবল ২০ কেজি করে ৪০ কেজি চাল মাত্র। এই ৪০ কেজি চালে তিন মাস একটি সংসার চালানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যার দরুণ মাছ ধরা বন্ধের সময় জেলেদের পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কাটাতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মহালছড়ির সব জেলে পরিবারেই এখন নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে।’

কাপ্তাই হ্রদখাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার সিলেটিপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হক (৪৯) জানান, ‘দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় ধরে কাপ্তাই লেকের মহালছড়ি অংশে মাছ আহরণ করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন তিনি। তবে এখনও সরকারিভাবে নিবন্ধিত হতে পারেননি তিনি। ফলে তিনি আট সদস্যের সংসার নিয়ে বিপাকে আছেন।

একই এলাকার আরেক মৎসজীবী ফুলচাঁন মিয়া (৪০) জানান, তিনি সরকারিভাবে নিবন্ধিত একজন জেলে। বয়োজ্যেষ্ঠ অসুস্থ মা-বাবা, স্ত্রী, দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে মিলিয়ে তার পরিবারে আট জন সদস্য। মাছ ধরা বন্ধ, তাই আয়-রোজগারও নেই এখন। এতে করে পুরো পরিবার নিয়ে পড়েছেন দুর্বিপাকে। পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’বেলা আহার তুলে দিতে এখন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে তাকে। তিনি আরও বলেন, ‘তবে এক মাস অতিবাহিত হতে চললেও এখনও রেশন পাইনি আমরা। কখন পাবো তাও ঠিকঠাক জানি না।‘ ‘আর শুধু ২০ কেজি চাল দিয়েই কি একটি পরিবার চলতে পারে?’ আক্ষেপের সুরে এমন প্রশ্ন ছোড়েন ফুলচাঁন মিয়া।

আরেক জেলে আব্দুল হক বলেন, ‘যারা সরকারিভাবে নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন, তারা ২০ কেজি হলেও চাল পাবেন। আর আমরা যারা অনিবন্ধিত জেলে আছি, তাদের কী অবস্থা তা একবারও ভাবেন না কেউ। অথচ আমরাও নিবন্ধিত জেলেদের মতো সরকারকে নিয়মিত রাজস্ব দিয়ে আসছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘একেতো করোনার প্রভাবে আমরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তার ওপর একটা ঈদ গত হলো। এমন সংকটময় সময়ে বন্ধ হলো মাছ ধরা, ফলে আয় রোজগারও বন্ধ হয়ে গেলো। অথচ এই ঈদের সময় আমাদের খোঁজ কেউ নিলো না।’

কাপ্তাই হ্রদমহালছড়ি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রবীণ চন্দ্র চাকমা বলেন, ‘মাছ ধরা তিন মাস বন্ধ থাকলেও সরকারিভাবে রেশন বরাদ্দ আসে মাত্র দু’মাসের। এবারও দু’মাস ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে নিবন্ধিত জেলেদের।’

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) মহালছড়ি উপ-কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসরুল্লাহ্ আহমেদ বলেন, ‘দারিদ্রতার কারণে অনেকেই চুরি করে মাছ ধরার চেষ্টা করেন। তবে আমরাও সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। কেউ যেন চুরি করে মাছ ধরতে না পারেন। এ জন্য নিয়মিত টহল পরিচালনা করছি। সার্বক্ষনিক সাত জন প্রহরী নিয়োজিত রয়েছে কাপ্তাই লেকের মহালছড়ি অংশে।’

তিনি জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে মহালছড়ির জেলেদের থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৭ লাখ ৬০ হাজার ২৫৪ টাকা। তবে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ এক কোটি ছাড়িয়েছিল। মৎস্য খাত হতে আদায় হওয়া রাজস্ব নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত জেলেদের অবদান। তাই মাছ ধরা বন্ধের সময় এসব জেলেদের পাশে আরও ভালোভাবে দাঁড়ানোর বিষয়ে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের লিখিতভাবে অনুরোধ জানাবেন বলেও মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।