আদালতের পর্যবেক্ষণ: সিনহা হত্যা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড  

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় পড়া চলছে। সোমবার (৩১ জানুয়ারি) ২টা ২৫ মিনিটের দিকে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল তিনশ’ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু করেন। এসময় বিচারক রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘আমি মেজর সিনহা হত্যা মামলার বিভিন্ন ইস্যু ও খুঁটিনাটি বিষয় খোঁজার চেষ্টা করেছি। এতে এপিবিএনের তিন সদস্য দায়িত্বে ছিলেন। এ তিন জনই প্রথমে সিনহার গাড়িটি আটকানোর পর ছেড়ে দেন। পরে পুলিশ পুনরায় গাড়িটি আটকালো এবং ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে গুলি করা হয়। এতে প্রমাণিত হয় সিনহা হত্যা একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’

বিচারকের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, সিনহার সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের সাক্ষ্যের বিবরণীতে জানা যায়, চার রাউন্ড গুলি করে লিয়াকত আলী। এছাড়া লিয়াকতের জবানবন্দিতে ওসি প্রদীপ সিনহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন বলেও জানা যায়। সিনহার হাতে পিস্তল আছে ভেবে লিয়াকত গুলি করার কথা স্বীকারও করেছেন। শেষ পর্যন্ত ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে পৌঁছে সিনহার বামপাশে লাথি মারেন এবং সিনহা নিস্তেজ হয়ে যান।
 
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, একইভাবে এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতের জবানবন্দিতেও উঠে আসে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি। জবানবন্দিতে নন্দ দুলাল বলেন, লিয়াকত আগে থেকে সিলভার কালারের গাড়ি থামাতে বলেন। পরে দুই হাত উঁচু করে সামনের দিকে ঝুঁকে থাকা অবস্থায় সিনহাকে চার রাউন্ড গুলি করেন লিয়াকত। প্রদীপ ঘটনাস্থলে এসে বলেন, অনেক কষ্টের পর তোকে পেয়েছি। এরপর বুকের বাম পাশে লাথি মারেন এবং সিনহা নিস্তেজ হয়ে যান। ওসি প্রদীপের ভয়ে জব্দ তালিকা তৈরি করি। মূলত ওসি প্রদীপ যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন আমি সেভাবে করেছি। এতে হত্যায় ঘটনাস্থলে লিয়াকত, নন্দ দুলালের সক্রিয় ভূমিকা রাখার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। 

ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ আসামির উপস্থিতিতে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল রায় পড়া শুরু করেন। এ সময় এজলাসের এক কোণায় চিন্তিত ও বিমর্ষ অবস্থায় ওসি প্রদীপকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

মামলায় অভিযুক্তরা হলেন, টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন ও বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলী, প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্তকৃত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, বরখাস্ত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান, বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

সরেজমিন দেখা যায়, সিনহা হত্যা মামলার রায়কে ঘিরে সকাল থেকেই কক্সবাজার আদালত প্রাঙ্গণে ছিল কড়া নিরাপত্তা। খুব সকালে আদালতে পৌঁছানোর পর প্রধান ফটক থেকে শুরু করে এজলাস পর্যন্ত যেতে কয়েক দফা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিবন্ধকতা পার হতে হয়। ঢাকার বাইরে কোনও মামলার রায়ের এমন কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ বিরল। এ ধরনের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্প্রতি শুধু ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের সময়েই দেখা গিয়েছে। বিচারক আসার বেশ আগেই এজলাস কক্ষ গমগম করছিল সাংবাদিক ও আইনজীবীদের উপস্থিতিতে। স্থানীয় সাংবাদিকদের বাইরেও ঢাকা থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা কক্সবাজার আদালতে এসে উপস্থিত হয়েছেন।

এদিকে গত বছর ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে মামলাটির বিচারকাজ শুরু হয় এবং চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি সর্বশেষ দুই আসামির পক্ষে তাদের আইনজীবীদের যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বিচারকাজ শেষ হয়। পরে বিচারক ৩১ জানুয়ারি রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন। হত্যাকাণ্ডের ১৮ মাস পর এই মামলার রায় হতে চলেছে। আর ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি চায় সিনহার পরিবার।

পরিবারের পাশাপাশি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছে। আসামিপক্ষ বলছে, রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। কাজেই তারা খালাস পাবেন।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়ার শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি (টেকনাফে দুটি, রামুতে একটি) মামলা করেছিল।

সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া সিনহা ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য সেসময় প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। ওই কাজে তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপা দেবনাথ।

তবে কক্সবাজারের পুলিশ সে সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে। ঘটনার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে র‌্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। তদন্ত শেষে র‌্যাব ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।