রায়ের দিন রিট প্রত্যাহারের আবেদন চেয়ারম্যান সেলিম খানের 

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণের সুযোগে বাড়তি প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন বিতর্কিত ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান। কিন্তু সরকারি বিপুল অঙ্কের টাকা রক্ষায় রাষ্ট্রপক্ষের শক্ত অবস্থানে পূর্ব নির্ধারিত রায়ের দিন নিজের করা রিট প্রত্যাহারের আবেদন করেন তিনি। এ ঘটনায় আদালতের সময় নষ্ট করায় সেলিম খান ও তার দুই সহযোগীকে কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। 

এর মধ্যে সেলিম চেয়ারম্যানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তার অপর দুই সহযোগী রিটকারী আবদুল কাদের ও জুয়েলকে ২৫ লাখ করে মোট ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

বৃহস্পতিবার (৯ জুন) বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।   

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সেলিম খান প্রতারণা করেছেন। আদালতে জাল-জালিয়াতি করে কাগজ দাখিল করেন। আমরা এ বিষয়গুলো আগেই আদালতের নজরে এনেছি। আদালত সেগুলো আমলে নেন। শুনানির পর আদালত রায়ের দিন ধার্য্য করেন। কিন্তু রায়ের দিন সেলিম খান রিট আবেদন প্রত্যাহারের আবেদন করে। কিন্তু আদালত তার আবেদন আমলে না নিয়ে রায় ঘোষণা করেন এবং রায়ে তাকে ও অপর দু’জনকে বিজ্ঞ উচ্চ আদালতের সময় নষ্ট করায় এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড করা হয়।

এছাড়া সম্প্রতি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতির পদ থেকেও সেলিম খানকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।

স্থানীয় প্রশাসন সূত্র জানায়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনাপাড়ের একটি এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়, ওই ইউপির চেয়ারম্যান সেলিম খান তার ছেলেমেয়েসহ অন্যান্য জমির মালিকরা অস্বাভাবিক মূল্যে দলিল তৈরি করেছেন। ফলে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা।

জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে সাবেক জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বিষয়টি তদন্ত করলে বেরিয়ে আসে সরকারের কয়েকশ’ কোটি টাকা লোপাট পরিকল্পনার তথ্য।

উল্লেখ্য, গত ৪ জুন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে দুর্নীতি ও দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগে বিতর্কিত ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানকে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

প্রসঙ্গত, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনা পাড়ে একটি এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরে ৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়, চেয়ারম্যান সেলিম খান, তার ছেলেমেয়েসহ অন্যান্য জমির মালিকরা অস্বাভাবিক মূল্যে দলিল তৈরি করেছেন। ফলে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে জেলা প্রশাসক তদন্ত করলে বেরিয়ে আসে সরকারের কয়েকশ' কোটি টাকা লোপাটের পরিকল্পনার তথ্য।

ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে জেলা প্রশাসক উল্লেখ করেন, ওই মৌজায় জমির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা যায়, অধিগ্রহণ প্রস্তাবিত ও পূর্বে অধিগ্রহণকৃত দাগগুলোর জমির হস্তান্তর মূল্য অস্বাভাবিক। এছাড়া এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় জনস্বার্থ ও সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে সৃজন করা দলিল ছাড়া ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর মৌজার অন্যান্য সাফকবলা দলিল বিবেচনায় নিয়ে ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অধিগ্রহণের প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। উচ্চমূল্যের সেই দলিলগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করলে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতি হতো। এছাড়া মৌজা মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণ ভূমি হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে সমস্যায় পড়তো।

বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের পক্ষে অবস্থান নেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু নঈম পাটওয়ারী দুলালসহ একটি অংশ। এ বিষয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানিয়েছিলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্রাক্কলন দিয়েছি। মন্ত্রণালয়কে বলেছি, সব দলিল ধরে মূল্য নির্ধারণ করলে দাম হতো ৫৫৩ কোটি টাকা। আর যে দলিলগুলো উচ্চমূল্যের সেগুলো বাদ দিয়ে প্রাক্কলন করলে দাম আসে ১৯৩ কোটি টাকা। এর বিরুদ্ধে সেলিম খান ও অন্যরা আদালতে রিট করেন। 

এদিকে বাড়তি দামে জমি বিক্রির চেষ্টার অভিযোগের পর সেলিম খানের অবৈধ উপায়ে বালু উত্তোলনের বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। চাঁদপুরের নদী অঞ্চলে শত শত ড্রেজার বসিয়ে গত কয়েক বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে তিনি বালু উত্তোলন করে আসছিলেন। দীর্ঘদিন বালু ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে নদীভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইলিশ সম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য। পরে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিআইডব্লিউটিএ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামত ও চিঠির আলোকে সরকারি সম্পদ ও ইলিশ রক্ষায় ভূমি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ। 

ওই চিঠির পর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে ভূমি মন্ত্রণালয়ও। এরই মধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ ও চেয়ারম্যান সেলিম খানকে গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন নদীপাড়ের ভাঙনকবলিত মানুষ। তবুও বালু উত্তোলনের জন্য উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। যা সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ খারিজ করে দেয়। এর ফলে চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয় তার অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন।

এদিকে গত ৬ এপ্রিল সেলিম খানের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ যাচাইয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুমিল্লার সহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সা’দাতের নেতৃত্বে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণের সুযোগে ৩৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা ও পদ্মা-মেঘনা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক। সংস্থাটি এখন আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। ইতোমধ্যে দুদকের আবেদনে সেলিম খানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।