মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে চাঁদপুরের ক্ষীর, বিউটির মাসে বিক্রি ৫ লাখ

অসচ্ছল পরিবারে জন্ম নিলেও স্বপ্নটা বড় ছিল বিউটি রাণী ঘোষের। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু দরিদ্র বাবা-মা তাকে সম্পূর্ণ সহায়তা দিতে পারেননি। অর্থকষ্টে অষ্টম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া এগোয়নি তার। বিয়ে হয়ে যায় ২০০৬ সালে। তবে স্বামীভাগ্য ভালো ছিল বিউটির। স্বামী উৎপল কুমার ঘোষের অনুপ্রেরণায় ও শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সহায়তায় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার। আজ তার প্রতিষ্ঠানে তৈরি ক্ষীর, দই এবং ঘি’র সুনাম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়েছে বিদেশেও। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী অন্য গৃহবধূদেরও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন বিউটি।  

চাঁদপুর মতলবের ঘোষপাড়া এলাকার গৃহবধূ বিউটি রাণী ঘোষ বলেন, ‌‘পড়াশোনা করে চাকরি করার ইচ্ছে ছিল। তবে অর্থের অভাবে পড়তে পারিনি। আমার স্বপ্ন ছিল কিছু করার। বিয়ের পর দেখলাম, শ্বশুর ক্ষীর, দই ও ঘি’র ব্যবসা করেন। সেই ব্যবসাকে বড় করার চিন্তা করি। শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীর অনুপ্রেরণায় একটি সমবায় সমিতিতে যোগ দেই। পরে বিআরডিবি থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। এভাবেই ব্যবসা বাড়তে থাকে।’

এদিকে কাল শুরুর অল্প দিনেই বিউটির ক্ষীরের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আশপাশের নারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন একটি সমিতি। নিজের ঘরের এক পাশে ক্ষীর বানিয়ে লাভের মুখ দেখেন বিউটি। সংসারে স্বচ্ছলতা আসে। গুণমান আর অনন্য স্বাদের জন্য তার বানানো ক্ষীর ভোজনরসিকদের কাছে সমাদৃত। 

বিউটি জানান, এক কেজি ক্ষীর তৈরি করতে খরচ হয় তার ৩৫০ টাকা। বিক্রি করেন ৪০০ টাকায়। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ কেজি ক্ষীর তৈরি করেন তিনি। সে হিসাবে প্রতি মাসে প্রায় ৪-৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়। এরমধ্যে তার লাভ থাকে ৪০-৪৫ হাজার টাকা।

বর্তমানে বিউটির ক্ষীর চাঁদপুর, কুমিল্লা ও আশপাশের জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পৌঁছে গেছে এই সুস্বাদু ক্ষীর। স্বজনদের মাধ্যমে অর্ডার করছেন প্রবাসীরা। 

দেশ-বিদেশের লোকজন ক্ষীর কেনেন উল্লেখ করে বিউটি বলেন, ‘বর্তমানে দেশ-বিদেশের লোকজন আমার থেকে ক্ষীর নেন। ব্যবসা আরও বড় করার আশা আছে। এই উপার্জন দিয়ে ছেলেকে পড়ালেখা করিয়ে মানুষ করতে চাই।’

বর্তমানে উপজেলা সদর বাজারে ‘আনন্দ দধি-ক্ষীর হাউস’ নামে একটি দোকান রয়েছে তার। সেখানেই চলে বেচাকেনা। কর্মের স্বীকৃতিও পেয়েছেন বিউটি। বিআরডিবি থেকে পেয়েছে জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদক। এছাড়া মহিলা অধিদফতর থেকে পেয়েছে জয়িতা পুরস্কার।

দুধ বিক্রেতা রহিম বেপারি বলেন, ‘বিউটির কাছে প্রতিদিন ১০ কেজি দুধ বিক্রি করি। সেই সঙ্গে তার কাজেও সহযোগিতা করি। ক্রেতারা ক্ষীরের প্রশংসা করেন। তার তৈরি দই-ঘিও অনেক ভালো।’

বর্তমানে বিউটির সঙ্গে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন আরও কয়েকজন কর্মী। বিউটির কর্মীরা বলেন, ‘আমরা তার ক্ষীর, দই দেখভাল করি। তাকে কাজকর্মে সহযোগিতা করি। এ কাজ করে আমরা উপকৃত হচ্ছি। ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচের জোগান দিচ্ছি।’

বিউটির সফলতার কথা জানিয়ে পল্লী উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা মো. আবুল হাসনাত বলেন, ‘সমাজে পিছিয়ে পড়া অবহেলিত মহিলা-পুরুষদের নিয়ে আমরা কাজ করি। এরই ধারাবাহিকতায় বিআরডিবি থেকে কয়েক দফা ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন বিউটি। তিনি যে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করেছেন–সেটি বিরল।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে বিআরডিবি থেকে জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদক পেয়েছেন বিউটি। আশা করি, তার মতো অনেকেই আমাদের থেকে ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হবেন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবেন।’