‘কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। তবে আমাদের এখানে শুধু সন্ধ্যা বা রাতে নয়, সকাল-দুপুর-বিকাল, সব সময়ই ওপার (মিয়ানমার) থেকে আসা গোলাগুলির শব্দ কানে বাজে। যে কারণে ভয় এখন অভয় হয়ে দাঁড়িয়েছে!’ কেমন আছেন জানতে চাইলে মিয়ানমার সীমান্ত ঘেষা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রুর বাঁশফাঁড়ি পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইবরাহিম এভাবেই জবাব দেন।
কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীস্থল বাংলাদেশ-মিয়ানমার মিত্র সড়ক থেকে সাত কিলোমিটার ভেতরে সীমান্তে বসবাসকারী ইবরাহিমের কাছে গোলাগুলির শব্দ এখন অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
ইবরাহিম জানান, পাহাড়ের পেছনে প্রতি দিনই গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। তবে এখন আর ভয় কাজ করে না। কারণ, এখানে গোলাগুলি এখন নিত্যদিনের ঘটনায় রূপ নিয়েছে। বরং গুলির শব্দ না আসলে, মনে প্রশ্ন জাগে—কেন গুলির আওয়াজ নেই? চিন্তা করে দেখেন, কোন পর্যায়ে গেলে এমন হয়।
তিনি বলেন, ‘সীমান্তে যাওয়া-আসার সুযোগে প্রায়ই কাঁটা তারের বেড়া থেকে অস্ত্র-সশস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনীর পোশাকে লোকজনকে হাঁটতে দেখা যায়। কিন্তু আসলে তারা কারা, সেটা বুঝা যায় না। আমরা শুনেছি, সেখানে আরকান আর্মি (এএ)-এর সঙ্গে সেদেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলছে। প্রকৃত পক্ষে তাও বিশ্বাস করা মুশকিল।’
প্রায় মাসখানেক ধরেই বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু পয়েন্টের বাংলাদেশ-মিয়ানামার সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। এ অবস্থায় অসহায় হয়ে পড়েছেন নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা। সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মাঝেও এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। যদিও সতর্ক অবস্থানে থাকার কথা স্বীকার করেছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিবি।
হেডম্যান পাড়ার অন্যথাইন বলেন, ‘দেখেন, এখনও গুলির শব্দ পাচ্ছি। এভাবে প্রতি দিন চলছেই। আসলে সেখানে কী হচ্ছে—সেটা বলা যাচ্ছে না। আমরা শুধু গুলির শব্দ পাই। মাঝেমধ্যে আকাশপথে হেলিকপ্টার ও যুদ্ধ বিমান দেখতে পাই। আর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে দেখা মেলে সেনাবাহিনীর পোশাকে কাঁধে অস্ত্র নিয়ে দলে দলে হাঁটছেন তারা।’
অন্যথাইন আরও বলেন, ‘গোলাগুলির কারণে ইতোমধ্যে আমাদের প্রায় ৫০০ মানুষের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি ভয়ে অনেক পরিবার তাদের বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপদে কাছাকাছি স্বজনদের বাড়িতে রেখে এসেছেন।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলম জানান, সীমান্তের ওপাড়ে প্রতিদিনই গোলাগুলি হচ্ছে। এখন পাহাড়ে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। তার এলাকার বেশিরভাগই মানুষ চাষাবাদ করে সংসার চালায়। কিন্তু সীমান্তে গোলাগুলির কারণে অনেকে বেকার আছেন। ভয়ে সেখানে তারা যাচ্ছে না। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরাও চলাচলে সতর্ক করেছে।
চলাচলে সতর্কতা
জানা যায়, গত পাঁচ বছর ধরে ওই সীমান্তের শূন্যরেখা কোনা পাড়ায় বসবাস করে আসছেন চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। সম্প্রতি মর্টার শেল-গোলা ছোড়ার পাশাপাশি সীমান্তে হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণের ঘটনায় নো ম্যানস-ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের ওপরও চলাচলে সতর্ক করেছে সেখানকার দায়িত্বে থাকা বিজিবি।
নো ম্যানস-ল্যান্ডে দায়িত্বে থাকা বিজিবির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে জানান, সীমান্তের অবস্থা খুব খারাপ। এখানে লোকজনের চলাচলে সতর্ক করা হয়েছে। জরুরি না থাকলে এখানকার লোকজনকে ঘোরাফেরা না করতে বলা হয়েছে।
নো ম্যানস-ল্যান্ডে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা দিল মোহাম্মদ জানান, আজকেও (রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর) বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া গেছে। আসলে এ ‘গুলিখেলার’ শেষ কবে হবে, তার কোনও হিসেব নেই। আমাদের শিবিরের শিশু ও নারীরা ভয়ে থাকে। আর আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে শুনতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।
এদিকে সম্প্রতি তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল ও গোলা এসে পড়ার ঘটনায় ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত উ অং কিয়াউ মো-কে ডেকে কড়া প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ।