পেঁপে চাষে ভাগ্যবদল, কমছে বেকারত্ব

পেঁপে চাষে ভাগ্য বদলে গেছে চট্টগ্রামের অনেক বেকার মানুষের। এর মধ্যে পেঁপে বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী এলাকার বাসিন্দা হারুনুর রশিদ (৫৫)। গত চার মাসে এক লাখ ২০ হাজার টাকার পেঁপে বিক্রি করেছেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালে আগুনে পুড়ে বসতঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান হারুনুর রশিদ। এরপর চরম হতশা ঘিরে ধরে। পাঁচ মেয়ে ও তিন ছেলেসন্তান নিয়ে খুব কষ্টে চলছিল সংসার। কিছুদিন পর উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে পেঁপেসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। পরে ৫০ শতক জমিতে পেঁপে চাষ করেন। এখন ফলে ভরপুর হয়ে উঠেছে পেঁপে বাগান। বাগানটি কৃষি অফিস প্রদর্শনীর জন্য রেখেছে। এ বাগান দেখে উৎসাহিত হচ্ছেন স্থানীয় বেকার যুবক ও কৃষকরা।

হারুনুর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৫০ শতক জমিতে পেঁপে আবাদ করেছি। ফলন খুব ভালো হয়েছে। গত চার মাসে এক লাখ ২০ হাজার টাকার পেঁপে বিক্রি করেছি। বাগানে যে পরিমাণ ফলন আছে, তাতে আরও তিন লাখ টাকা বিক্রির আশা করছি। বাগান করতে খরচ হয়েছে এক লাখ ২৯ হাজার টাকা। পেঁপে আবাদ করে আমি এখন স্বাবলম্বী।’

তিনি বলেন, ‘দোহাজারীর শঙ্খ নদীর চরে প্রচুর সবজি চাষ হয়। তবে সবজির জন্য হিমাগার না থাকায় প্রচুর সবজি নষ্ট হয়। চাষিরা নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। আগে প্রতিদিন ভোরে একটি ট্রেন দোহাজারী থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াত করতো। এই ট্রেনে চাষিরা নিজেদের উৎপাদিত সবজি নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজারসহ বড় বড় বাজারে নিয়ে বিক্রি করতেন। অল্প ভাড়ায় ট্রেনে শহরে যাওয়া যেতো। বর্তমানে ট্রেনটি বন্ধ। সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে পাইকারদের কাছে। পাইকারদের বেঁধে দেওয়া দামেই সবজি বিক্রি করতে হয়। এতে একদিকে যেমন নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা অন্যদিকে সবজির মূল মুনাফা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে চলে যাচ্ছে।’চট্টগ্রাম-পেঁপে 02

লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকার বাসিন্দা মাহাবুবুর রহমান অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। চার মাস আগে ২০ শতক জমিতে পেঁপে চাষ করেন। বর্তমানে তার বাগানে পেঁপের ভালো ফলন হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘২০ শতক জমিতে পেঁপে চাষ করতে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। কোনও গাছে ২০ কেজি আবার কোনও গাছে এক মণ পেঁপে ধরেছে। আশা করছি, খরচ বাদে দ্বিগুণ লাভ হবে। পেঁপে চাষে কষ্ট কম। ভালো ফলন হওয়ায় লাভ বেশি। লোহাগাড়ার চুনতি উপজেলায় অনেকের পেঁপে চাষে ভাগ্য বদলে গেছে।’

চট্টগ্রামে এবার এক হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে পেঁপের আবাদ হয়েছে। যা থেকে আনুমানিক ২৫ হাজার টন পেঁপে উৎপাদনের আশা করছে কৃষি বিভাগ। এর মধ্যে চন্দনাইশ উপজেলায় এবার ১২৫ হেক্টর জমিতে পেঁপের আবাদ হয়েছে। এর থেকে তিন হাজার ৯৩৫ টন পেঁপের ফলন পাওয়ার আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।

চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রাণী সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চন্দনাইশে এবার ১২৫ হেক্টর জমিতে পেঁপে চাষ হয়েছে। এর থেকে তিন হাজার ৯৩৫ টন ফলন পাওয়া যাবে আশা করা যায়। এবার পেঁপের ফলন ভালো হয়েছে। প্রতি বছর এখানে পেঁপের চাষাবাদ বাড়ছে। এখানকার মাটিও পেঁপে চাষের জন্য উপযোগী।’

তিনি আরও বলেন, ‘চন্দনাইশে দুই ধরনের জাতের পেঁপের চাষ হয়। এর মধ্যে একটি রেড লেডি অপরটি গ্রিন লেডি। গ্রিন লেডি জাতের পেঁপে শুধুমাত্র সবজি হিসেবে খাওয়ার জন্য। রেড লেডি পেঁপে সবজির পাশাপাশি পাকিয়ে খাওয়া যায়। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে পেঁপে ও অন্যান্য চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়। চাষিদের বাগান তদারকির জন্য মাঠপর্যায়ে একাধিক কৃষি কর্মকর্তা কাজ করছেন।’

চট্টগ্রাম-পেঁপে 03
কয়েকজন চাষি জানিয়েছেন, পেঁপের প্রতিটি চারা ২০ থেকে ২৫ টাকায় কিনতে হয়। আবার কোনও কোনও চাষি বীজ থেকে চারা উৎপাদন করেন।

চন্দনাইশ উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মৃণাল কান্তি দাশ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার শুধুমাত্র দোহাজারী ইউনিয়নে ১০ হেক্টরের বেশি জমিতে পেঁপের আবাদ হয়েছে। উপজেলার প্রতিটি এলাকায় কমবেশি পেঁপের আবাদ হয়। উপজেলার অনেক বেকার যুবক পেঁপে চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এতে কমছে বেকারত্ব। পেঁপে চাষ অনেক লাভজনক। এজন্য বেকার যুবকরা পেঁপে চাষে ঝুঁকছেন। প্রতিটি গাছে ৫০ থেকে ৬০ কেজি করে পেঁপের ফলন হয়। আমরা নিয়মিত পেঁপে চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম জেলায় ২০২১-২২ সালে প্রায় এক হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে পেঁপের আবাদ হয়েছে। যা থেকে ২৫ হাজার টন পেঁপে উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আক্তারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফল ও সবজি হিসেবে পেঁপে পছন্দ করে সবাই। বাণিজ্যিক আবাদের জন্য এটি অত্যন্ত উপযোগী ফসল। সাধারণত রোপণের ছয় মাসের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়। এক একর জমি থেকে সাধারণত ছয় মাস পর লক্ষাধিক টাকার পাকা পেঁপে এবং অর্ধলক্ষাধিক টাকার কাঁচা পেঁপে বিক্রি করা সম্ভব। সঠিকভাবে যত্ন নিলে দুই বছর পর্যন্ত একটি পেঁপে বাগান থেকে টানা ফসল সংগ্রহ করা সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, ‘বসতবাড়ির আশপাশে কিংবা ছাদবাগানে একটি অথবা দুটি পেঁপে গাছ রোপণ করলে আমরা সারা বছর ফল ও সবজি খেতে পারি।’