আইন ভেঙে শতবর্ষী খাল ভরাট, পুনর্খননে ব্যয় হবে ১০ কোটি

চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের শতবর্ষী ডাবরখালী খাল। এই খালের পাশ ঘেঁষেই নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। শিল্পনগরের প্লট তৈরির সুবিধার্থে ‘আইন না মেনে’ খালের সোয়া দুই কিলোমিটার ভরাট করে ফেলেছে বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। পরে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে খালটি পুনর্খনন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ভরাট করা এই খাল পুনর্খননে এখন আবার ব্যয় হবে ১০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, শতবর্ষী ডাবরখালী খালের দৈর্ঘ্য প্রায় সোয়া ছয় কিলোমিটার। প্রস্থ কোথাও ২০ ফুট, কোথাও ৪০ ফুট। খালটির শুরু মীরসরাই উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের চরশরৎ গ্রামে। ওই গ্রামের এক পাশে ৫ হাজার একরের মতো নিচু কৃষিজমি রয়েছে। সেই জমির পানি খালটি হয়ে বঙ্গোপসাগরে নিষ্কাশিত হয়। বঙ্গোপসাগরের কাছে খালের ওপর পুরনো একটি স্লুইসগেট রয়েছে। সেখান থেকে সমুদ্র পর্যন্ত অংশের পানি লবণাক্ত থাকে। বাকি অংশের পানি মিঠা। খালের মিঠা পানির অংশে দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। ওই জমিতে বর্ষায় ধান এবং বছরের অন্য সময় রবি শস্য, সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ হয়।

চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীতে ৩০ হাজার একরের বেশি জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। শিল্পনগরের ভেতর কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) করা হচ্ছে, যার একটি বেপজার। জমির পরিমাণ ১ হাজার ১৫০ একর। এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যই খাল ভরাট করেছে বেপজা। খালটি ভরাট করার ক্ষেত্রে বেপজা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) মহাপরিকল্পনা ও তাদের সঙ্গে করা চুক্তির শর্ত মানেনি বলে অভিযোগ উঠেছে, ভাঙা হয়েছে আইনও। পরে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে বেপজা ভরাট করা খালটি আবার খননের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডাবরখালী খালের শুরুর এক কিলোমিটার আর শেষ দিকের তিন কিলোমিটারের অস্তিত্ব আছে। মাঝখানের সোয়া দুই কিলোমিটার খাল বালু দিয়ে ভরাট করা। খাল ভরাটের প্রতিবাদে ২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি ওই এলাকায় মানববন্ধন করেন প্রায় ১ হাজার কৃষক। কৃষকদের অভিযোগ, খাল ভরাটের কারণে বর্ষায় পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষিজমির একাংশে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা এখন মাছ একেবারেই কম পাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘খালটি ভরাট করা ঠেকাতে তখন আন্দোলন করেও লাভ হয়নি।’

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে খাল আছে সাতটির মতো। এর মধ্যে তিনটি বড় বামনসুন্দর, ইছাখালী ও ডাবরখালী। বেজা বলছে, তারা যেসব জায়গায় ভূমি উন্নয়ন করছে, সেখানকার খাল রক্ষা করেই বালু ফেলা হচ্ছে। ডাবরখালী খালের প্রাকৃতিক প্রবাহ ঠিক রেখে সড়ক তৈরির জন্য তারা এক কোটি টাকা ব্যয় করে একটি সেতুও নির্মাণ করেছিল। তবে খাল ভরাট করায় সেতুটির অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। একই কারণে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে বর্ষার সময় পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি করা একটি স্লুইসগেটও।

অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে স্লুৃইচগেটটিও

স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, খাল ভরাট করে নালা তৈরি করা এবং সেই নালা আরেকটি খালের সংযুক্ত করে দেওয়ার চিন্তাটি অদূরদর্শী। কারণ, বর্ষা মৌসুমে বামনসুন্দর খালই পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনে সক্ষম নয়। আরেকটি খালের পানি সেই খাল দিয়ে সাগরে নিষ্কাশন করার চিন্তা ভুল।

দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ করছে বেজা। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার দায়িত্বও তাদের। এই শিল্পনগরের বড় অংশজুড়ে ভূমি উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে। বেশ কিছু শিল্পকারখানাও সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেজা বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের যে মহাপরিকল্পনা করেছে, সেখানে সব কটি খাল রক্ষার কথা বলা হয়েছে।

বেপজা শুধু বেজার মহাপরিকল্পনা ও চুক্তির শর্তই ভঙ্গ করেনি, তারা খালটি ভরাট করার মাধ্যমে পানি আইনও ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পানি আইনে (২০ নম্বর ধারা) বলা হয়েছে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা জলাধার ভরাট করে জলস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ বা তার প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খালটি ভরাট করার ক্ষেত্রে বেজা আপত্তি জানিয়েছিল। তবে বেপজার কিছু কর্মকর্তা বেপরোয়া মনোভাব দেখিয়েছিলেন। তারা খালটি ভরাট থেকে সরে আসেননি। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশেই খালটি পুনর্খনন করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় বেপজা।

বেপজা সূত্রে জানা গেছে, খালটি পুনর্খননের জন্য গত ৩১ জানুয়ারি দরপত্র আহ্বান করে বেপজা। আগামী ২ মার্চ দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। খালটি খননে যে ১০ কোটি টাকা ব্যয় হবে, তা বেপজা নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করবে। আগে ভরাট করতে ব্যয় করা ৩ কোটি টাকাও বেপজার নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে। বেপজা বলছে, খালটি ভরাট করার সময় তাদের লক্ষ্য ছিল, পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে ছোট নালা তৈরি করা হবে। সেটির সংযোগ থাকবে ৩ কিলোমিটার দূরের বামনসুন্দর খালের সঙ্গে।

ডাবরখালী-02
ইছাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল মোস্তফা বলেন, ২০১৮ সালে খালটির দুই কিলোমিটার অংশ খনন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। বেপজা খালের সোয়া দুই কিলোমিটার ভরাট করেছে ২০২১ সালে। বড় অংশ ভরাট করে ফেলায় খালটি এখন মৃতপ্রায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক এনামুল হক বলেন, ‘খালটি আঁকাবাঁকা হওয়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যাঘাত ঘটছিল। তাই ভরাট করা হয়েছিল। তবে সরকারের নির্দেশে আবার খনন করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘খালটি আঁকাবাঁকা ছিল। এখন খনন করা হবে সোজা করে।’

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘খাল ভরাট করে বেপজা বড় ধরনের ভুল করেছে। তারা আইন ভঙ্গ করেছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় খালটি পুনরায় খনন করতে তাদের নির্দেশ দিয়েছে। আমরাও তাগিদ দিয়েছি। তারা রাজি হয়েছে খালটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে।’

উল্লেখ্য, খালটি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জীবন কুমার সরকারকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারাও খালটি নতুন করে খননের সুপারিশ করেছে।