লাভ পয়েন্ট: বয়ে বেড়ায় ভালোবাসার এক অনুপম নিদর্শন

ভালোবাসার জন্য কত শত গল্প রয়েছে বিশ্বজুড়ে। আপন রূপে নিজের ভালোবাসা প্রকাশে নিজে করেছে হাজারো কাণ্ড। কিন্তু রাঙামাটিবাসী এক যুগলকে স্মরণীয় করে রেখেছে নিজের বিবেক ও ভালোবাসার তাড়নায়। এই দম্পতির মর্মান্তিক মৃত্যুকে ঘিরে যে আবেগ সৃষ্টি হয়েছে সেটা স্মরণ করে রাখতে শহরের অদূরে পলওয়েল পার্কে স্থাপন করা হয় দেশের প্রথম লাভ পয়েন্ট। যা এখন ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

এখানকার শোকগাথা পড়ে কেউ হন আপ্লুত কেউবা খুঁজে পান নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রেরণা। আর ভালোবাসার উপলব্ধি প্রকাশে এমন নির্মাণ বলে মত কর্তৃপক্ষের।

পলওয়েল পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, দিনটি ছিল ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ মধ্য দুপুর। আমেরিকা প্রবাসী আলাউদ্দিন পাটোয়ারী ও তার নববধূ আইরিন সুলতানা লিমা হ্রদের শান্ত নীল জলের স্নিগ্ধতা উপভোগ করতে বোট ভাসায়। বোটটি মধ্য হ্রদে আসতেই হঠাৎ ক্ষণিকের এক দমকা হাওয়ায় সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়। বাতাসের তীব্রতায় উল্টে যায় বোটটি। আর দুই দিন পর পলওয়েল পার্কের অদূরে হ্রদের শান্ত জলরাশিতে ভেসে ওঠে দম্পতির মরদেহ।

২০১৪ সালের ১৯ মার্চ মধ্য দুপুরে হ্রদের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন আলাউদ্দিন-লিমা দম্পতি

তবে মরদেহ ভেসে ওঠার পর সবার নজরে নজর কাড়ে যে দৃশ্যটি; সেটি হলো স্বামী-স্ত্রী একে-অপরের সঙ্গে আলিঙ্গনরত অবস্থায় রয়েছেন। অর্থাৎ মৃত্যুর সময়েও প্রিয়তমা স্ত্রীকে ছেড়ে যাননি একসময়ে সাঁতারে পুরস্কার পাওয়া স্বামী আলাউদ্দিন। দুজনেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন একসঙ্গে জড়িয়ে থেকে। মৃত্যুও তাদের আলাদা করতে পারেনি।

অবশেষে আলাউদ্দিন-লিমার এই মর্মান্তিক ঘটনা এবং বিপদের সময়ে সঙ্গীকে ফেলে না গিয়ে একে-অপরের আলিঙ্গনে থাকার স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্দেশে ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর রাঙামাটির পলওয়েল পার্কে আনুষ্ঠানিকভাবে লাভ পয়েন্ট উদ্বোধন করা হয়। লাভ পয়েন্টে প্রেমিকযুগল কিংবা দম্পতিরা তাদের ভালোবাসার বন্ধন সারা জীবন অটুট রাখার নিদর্শনস্বরূপ লাভ লক করে চাবি ফেলে দেন হ্রদে। ভোলেন না নিজেকে ফ্রেমবন্দি করতে।

আলাউদ্দিন-লিমা দম্পতি

এক যুগলের মর্মান্তিক মৃত্যুকে স্মরণীয় করে রাখতে এমন স্থাপনা নির্মাণ করে রাঙামাটিবাসী ও প্রশাসন যে উদারতা ও অকৃত্রিম ভালোবাসার নজির স্থাপন করেছে তাতে  মুগ্ধ আগত পর্যটকরা। যার ফলে তারা জানতে পারছে ভালোবাসার এই গল্প। লাভ পয়েন্টে দম্পতির শোকগাথা পড়ে দর্শনার্থীরা হন রোমাঞ্চিত। এমন উদ্যোগের জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা।

রাঙামাটি পলওয়েল পার্কে বেড়াতে আসা দম্পতি মো. সোহেল রানা ও নার্গিস সুলতানা বলেন, ‘এই লাভ পয়েন্টের বিষয়ে অনেক শুনেছি। অনেকবার আসতে চেয়েও সময় সুযোগের অভাবে আসতে পারিনি। এবার সময় বের করে এসেছি এবং তাদের (আলাউদ্দিন-লিমা) গল্প পড়ে অবাক হয়েছি। আলাউদ্দিন সাঁতার জানার পরও স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করলেন। এটি আসলেই সত্যিকারের ভালোবাসা। ভালোবাসা এমনই হওয়া উচিত।’

লাভ পয়েন্ট

আরেক পর্যটক নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছি রাঙামাটিতে। আসার পর শুনলাম পলওয়েল পার্কে লাভ পয়েন্ট নামের একটি স্থান আছে। শোনার পর দেখার ইচ্ছার জাগলো। তাই আসলাম এবং কিছু তুলে রাখলাম। প্রিয় মানুষের জন্য মানুষ কত কিছুই না করে থাকে। মানুষ আজীবন তাদের এই ভালোবাসা স্মরণ রাখবে।’

রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পলওয়েল পার্ক বর্তমানে পর্যটকদের কাছে বিনোদনের একমাত্র কেন্দ্র। তার অন্যতম লাভ পয়েন্ট। বিশেষ করে নববিবাহিতদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে স্থানটি। বিশেষ বিশেষ দিবসে পর্যটকদের সমাগম আরও বৃদ্ধি পায়। সকলের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করেছে পুলিশ।’