নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে সরকারি ভবন নির্মাণ, ঢাকায় বসে তদারকি, ব্যয় নিয়ে লুকোচুরি

বান্দরবান পৌরসভার বালাঘাটায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আওতায় হর্টিকালচার সেন্টারের চারতলা অ‌ফিস ভবন নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকল্পের কা‌জের তদারকির দা‌য়ি‌ত্বে থাকা কৃষি অধিদফতরের কনসালট্যান্ট কোঅর্ডিনেটর একদিনের জন্যও কাজ দেখতে আসেননি। এমনকি কী পরিমাণ রড, বালু, সিমেন্ট, ইট ব্যবহার হবে; প্রকল্প ব্যয় কত তাও জানেন না বলে দাবি করেছেন এই কনসালট্যান্ট।

জেলা হর্টিকালচার সেন্টার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বালাঘাটায় ল্যাবরেটরি কাম হর্টিকালচার সেন্টারের চারতলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এম‌বি-ইসির (জে‌বি) লাইসে‌ন্স ব্যবহার করে নির্মাণকাজ করছেন ঠিকাদার মো. মোজাফফর আহমদ। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর‌ছে কৃষি অধিদফতরের টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি কাম হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন ও উন্নয়ন সংস্থা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হয়েছে। ওই সময় থেকে আগামী ১৮ মাসে শেষ হওয়ার কথা। 

হর্টিকালচার সেন্টার কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই প্রকল্পের ব্যয় নি‌য়ে চল‌ছে লুকোচুরি। প্রক‌ল্প সংশ্লিষ্ট কেউ বল‌ছেন, ব্যয় ১৮‌ কো‌টি ৬০ লাখ টাকা। আবার কেউ বল‌ছেন, ১৬‌ কো‌টি ৬০ লাখ, আবার কেউবা বল‌ছেন, সাত-আট কো‌টি টাকা। তবে ঠিক বরাদ্দ কত, তা কেউ বলছেন না। কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঠিকাদার জানেন। ঠিকাদার বলছেন, কনসালট্যান্ট ইঞ্জি‌নিয়ার জানেন। কনসালট্যান্ট ইঞ্জি‌নিয়ার বলছেন, কনসালট্যান্ট কোঅর্ডিনেটর জানেন। কনসালট্যান্ট কোঅর্ডিনেটর বলছেন, প্রকল্প পরিচালক জানেন। আবার বলছেন, ঢাকায় গিয়ে প্রকল্প পরিচালকের কাছ থেকে ব্যয়ের তথ্য নিতে।

পাইলিংয়ের প্রতি‌টি পিলা‌রে ১৬ মিলির (পাঁচ সুতা) সাত-আটটি ক‌রে রড দেওয়া হ‌য়েছে

কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিনি শুনেছেন প্রকল্পের বরাদ্দ ১৮‌ কো‌টি ৬০ লাখ টাকা। তবে তা সঠিক কিনা নিশ্চিত নন। অর্থ লুটপাট করতে প্রকল্প প‌রিচালক ও তদার‌কি‌তে থাকা কর্মকর্তা ও ঠিকাদারসহ সং‌শ্লিষ্টরা বিষয়টি নিয়ে লুকোচুরি খেলছেন। ভবনের সামনে লাগানো সাইন‌বো‌র্ডে প্রক‌ল্পের বিস্তা‌রিত লেখা থাক‌লেও ব্যয় উল্লেখ করা হয়নি। 

সরেজমিনে দেখা গেছে, ইতিম‌ধ্যে ভব‌নের পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এখন চল‌ছে পিলার তোলার কাজ। পাইলিংয়ের প্রতি‌টি পিলা‌রে ১৬ মিলির (পাঁচ সুতা) সাত-আটটি ক‌রে রড দেওয়া হ‌য়েছে। পিলারের ওপরের অংশে ২০ মি‌লির (ছয় সুতা) রড দেওয়া হচ্ছে। কোনও পিলারে ১৩-১৪‌টি, কোনোটিতে ১৬-১৭টি রড ব্যবহার করা হ‌চ্ছে। মেঝে উঁচু কর‌তে মোটা লাল বা‌লুর প‌রিব‌র্তে ব্যবহার করা হ‌চ্ছে পাহা‌ড়ের মা‌টি। আবার ঢালাইয়ের কাজে সিমেন্টের সঙ্গে লাল বালুর পরিবর্তে ব্যবহার করা হ‌চ্ছে লোকাল বালু। সেইসঙ্গে নিম্নমানের ইট ও খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। 

নির্মাণশ্রমিকরা বলেছেন, ভবন নির্মাণে নিম্নমানের খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। সিমেন্ট ও বালুও পরিমাণ মতো দেওয়া হচ্ছে না। ত‌বে ভবনের সামনে লাল বালু এনে রাখলেও তা ব্যবহার করা হয় না। লোক দেখা‌নোর জন্য সেগুলো রাখা হয়েছে। তাদের যেভাবে কাজ করতে বলেছেন ঠিকাদার, সেভাবেই করছেন তারা।

এ বিষ‌য়ে পৌরসভার বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সাগর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘ভবনটি নির্মাণে নিম্নমানের ইট, খোয়া, বালু ব্যবহার করা হচ্ছে। সিমেন্ট ও বালু পরিমাণ মতো দেওয়া হচ্ছে না। নিম্নমানের কাজ করে কো‌টি কো‌টি টাকা ঠিকাদা‌রের সহায়তায় লুটপাটের চেষ্টা করছেন প্রকল্প সং‌শ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। উচ্চপর্যা‌য়ের দায়িত্বশীলদের দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করালে এসব অনিয়ম ধরা পড়বে।’

মেঝে উঁচু কর‌তে মোটা লাল বা‌লুর প‌রিব‌র্তে ব্যবহার করা হ‌চ্ছে পাহা‌ড়ের মা‌টি

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হর্টিকালচার সেন্টার কার্যালয়ের দুজন কর্মকর্তা জানান, ঠিকাদার মোজাফফর কাজ‌টি কর‌ছেন। আমরা শুরু থে‌কেই লক্ষ্য ক‌রে‌ছি, পাইলিংয়ের সময় প্রতি পিলা‌রে ১৬‌ মি‌লির সাত-আটটি ক‌রে রড ব্যবহার করেছেন ঠিকাদার। ‌পাইলিংয়ের পর পিলারের ওপ‌রের অং‌শে আবার ২০ মি‌লির ১৬-১৭‌টি করে রড ব্যবহার কর‌ছেন। মাটিতে পুঁতে ফেলা রড ১৬‌ মি‌লির, এটি যাতে কেউ ধরতে না পারে সেজন্য ওপরে ২০ মি‌লি ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ মাটিতে পুঁতে ফেলা পাইলিংয়ের রড আরও মোটা এবং বেশি দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কারণ পাইলিংয়ের ওপর নির্ভর ক‌রে টি‌কে থাক‌বে ভবন‌। আমরা আগেও অ‌নেক কাজ ক‌রিয়েছি, তাই ম‌নে হ‌চ্ছে পাইলিংয়ের রড ব্যবহারে নয়-ছয় করা হ‌য়ে‌ছে। ‌নি‌চের অংশের পিলার মা‌টির নি‌চে চ‌লে যা‌বে বলে নিম্নমা‌নের সামগ্রী দি‌য়ে কাজ করা হ‌য়ে‌ছে। ১২-১৩ ফুট পর্যন্ত পাইলিংয়ের গভীরতা করার কথা থাকলেও কম করা হয়েছে। এতে নির্মাণের পর ভবনটি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তে পারে। 

এ দুজন কর্মকর্তা আরও জানান, মেঝেতে ইটের খোয়া ও লাল বালুর প‌রিব‌র্তে পাহা‌ড়ের মা‌টি ব্যবহার করা হয়েছে। কা‌জের তদারকির দা‌য়ি‌ত্বে থাকা কনসালট্যান্ট ইঞ্জি‌নিয়ার নোবেল চাকমা সবই জা‌নেন। তবু কিছু ব‌লছেন না। কারণ ঠিকাদারসহ তারা সবাই মিলে কো‌টি কো‌টি টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেবেন। এই ভব‌নের কাজ করার জন্য সং‌শ্লিষ্ট কা‌জের পি‌ডি থে‌কে শুরু ক‌রে সবাইকে মোটা অং‌কের টাকা দি‌য়ে ম্যানেজ করেছেন ঠিকাদার। ফলে কাজ নিম্নমানের হচ্ছে জেনেও কোনও পদ‌ক্ষেপ নি‌চ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।

পিলারের কাজ করা রাজমিস্ত্রি মো. হাসান ব‌লেন, ‘পাইলিংয়ের নিচের ভাগে কাজের সময় আমি এখানে ছিলাম না। অন্য সাইডে কাজ করেছি। পাইলিংয়ের উপরিভাগে কাজ শুরুর পর এখানে এসেছি। তাই বিস্তা‌রিত বল‌তে পার‌বো না। আপ‌নি যা দেখ‌ছেন, আমিও তাই দেখ‌ছি। শুনেছি, প্রতি ফ্লো‌রের জন্য চার কো‌টি টাকার বে‌শি ব্যয় ধরা হ‌য়ে‌ছে। কিন্তু সেভাবে কাজ হচ্ছে না। এতে আমা‌রও অবাক লাগ‌ছে।’

নিম্নমানের ইট ও খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে

ঠিকাদারের নিয়োগ করা ম্যানেজার মো. মুরাদ ব‌লেন, ‘আমাকে ঠিকাদার যেভা‌বে কাজ চালা‌তে ব‌লে‌ছেন, সেভা‌বেই কাজ ক‌রে যা‌চ্ছি। পাইলিংয়ের নিচের অংশে কী রড ব্যবহার করা হয়েছে, আর ওপরের অংশে কী রড ব্যবহার হচ্ছে, তা আমি জানি না। এ বিষয়ে ঠিকাদার জা‌নেন। কত টাকার কাজ সেটিও জা‌নি না।’ 

মোটা লাল বালুর প‌রিব‌র্তে পাহা‌ড়ের মা‌টি ব্যবহা‌রের বিষ‌য়ে তি‌নি ব‌লেন, ‘ঠিকাদার ব‌লে‌ছেন মেঝে ভরা‌টের জন্য কোনও বরাদ্দ নেই। ঠিকাদার নিজ থেকে এটি খর‌চ কর‌ছেন। এজন্য মা‌টি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে।’

মা‌টি বহন করে আনা ডাম্প ট্রাকের চালক মো. বেলাল হোসেন ব‌লেন, ‘বালাঘাটার আর্মি ব্রিগেডের সাম‌নের পাহাড় থে‌কে মা‌টিগু‌লো এনে এখা‌নে ভরাট কর‌ছি। আমা‌কে যেভা‌বে বল‌ছেন, ঠিকাদার সেভাবে করছি।’

ঠিকাদার মো. মোজাফফর আহমদের মোবাইল নম্বরে কল দি‌য়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‌‘আমি এখন ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলবো।’ বলে কল কেটে দেন। এরপর কল দিলেও রিসিভ করেননি। 

ভবনের কা‌জের তদারকির দা‌য়ি‌ত্বে থাকা কনসালট্যান্ট ইঞ্জি‌নিয়ার নোবেল চাকমা বাংলা ট্রিবিউনকে ব‌লেন, কাজ‌টি আমি তদারকি করলেও কী প‌রিমা‌ণ রড, বালু, খোয়া ও নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার হ‌বে; তা আমার জানা নেই। প্রকল্প ব্যয় কত, তাও জা‌নি না। হয়‌তো ১২‌-১৩ কো‌টি টাকা হবে। তবে এইটুকু বলতে পারি, কা‌জে কোনও ধর‌নের অ‌নিয়ম হ‌চ্ছে না।’

বালুর প‌রিব‌র্তে মা‌টি দেওয়ার বিষয়ে তি‌নি ব‌লেন, ‘যে‌হেতু জায়গা‌টি ছয়-সাত ফুট নি‌চুতে তাই পাহা‌ড়ের মা‌টি দি‌য়ে ভরাট করা হ‌চ্ছে। তবে মা‌টি না‌কি বালু দি‌য়ে ভরাট হবে, তা প্রকল্পে উল্লেখ নেই। সহজলভ্য হওয়ায় মা‌টি দেওয়া হ‌চ্ছে। আমি লাল বালু চি‌নি না, ঠিকাদার যে বালু ব্যবহার কর‌ছেন, তা লাল বালু ব‌লে‌ছেন।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কা‌জের দা‌য়ি‌ত্বে থাকা কনসালট্যান্ট কোঅর্ডিনেটর মো. রানা বাংলা ট্রিবিউনকে ব‌লেন, ‘আমার জানাম‌তে ভ্যাট বাদ দি‌য়ে সাত-আট কো‌টি টাকার প্রকল্প এটি। আর ভ্যাটসহ ১২‌ কো‌টি টাকার মতো হ‌তে পা‌রে।’

পাইলিংয়ের সময় প্রতি পিলা‌রে ১৬‌ মি‌লির সাত-আটটি ক‌রে রড ব্যবহার করেছেন ঠিকাদার

ভবনটি নির্মাণে ঠিক কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে মো. রানা বলেন, ‘প্রক‌ল্প ব্যয় ও ওয়ার্ক অর্ডার জান‌তে চাইলে আপনা‌কে ঢাকায় এসে পি‌ডি অ‌ফি‌স থেকে তথ্য সংগ্রহ কর‌তে হ‌বে। প্রকল্পের কা‌জের তদার‌কির দায়িত্বে আমি থাকলেও সরেজমিনে দেখতে যাইনি। ঢাকায় থেকে আমার প্রতি‌নি‌ধির মাধ্যমে সবসময় তদার‌কি কর‌ছি। কথা বলে জেনেছি, পাইলিংয়ে ১৬‌ মি‌লির সাত-আটটি এবং পিলা‌রে ২০‌ মি‌লির ১৭‌-১৮টি রড ব্যবহার করা হ‌চ্ছে। এটি নিয়‌মের মধ্যেই আছে। প্রক‌ল্পে কোনও অ‌নিয়ম হ‌চ্ছে না।’ 

প্রতি‌টি ফ্লো‌রের কাজের জন্য চার কো‌টি টাকা ব্যয় হ‌চ্ছে শোনা যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তি‌নি ব‌লেন, ‘এক‌টি ফ্লো‌রের কাজে আরও বেশি ব্যয় হয়। এখানে অ‌নেক কম খরচ হ‌চ্ছে।’

সার্বিক বিষ‌য়ে জান‌তে বাংলা‌দেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি কাম হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন ও উন্নয়ন প্রকল্পের প‌রিচালক তালহা জুবাইর মাসরুরকে একা‌ধিকবার কল দি‌লেও ধরেননি।