জীববৈচিত্র্য বনাম জীবিকা: সেন্টমার্টিনে টানাপড়েন

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে অবস্থিত এ দ্বীপে বসবাস করে প্রায় ১০ হাজার মানুষ। তাদের অধিকাংশের জীবিকা নির্ভর করে পর্যটন শিল্প এবং সাগরে মাছ ধরার ওপর। কিন্তু বর্তমানে পর্যটক আগমন ও মাছ ধরার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় দ্বীপবাসী কঠিন দুর্দিনে পড়েছেন।

দ্বীপে অধিকাংশ দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কটেজ, রিসোর্টসহ পর্যটনকেন্দ্রিক সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। জেলেদের মাছ ধরার নৌকা ঘাটে নোঙর করে পড়ে আছে। দ্বীপের বহু মানুষ আজ বেকার। রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার চরম অভাব-অনটনের মধ্যে দিন পার করছে। স্থানীয়দের চলাচলের ক্ষেত্রেও প্রশাসনের কঠোর নজরদারি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।

দ্বীপের এক জেলে ছব্বির আহমেদ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে সমুদ্রে মাছ ধরে সংসার চালাতাম। এখন মাছ ধরা বন্ধ, তাই ডাব বিক্রি শুরু করি। কিন্তু তাতেও চলছে মন্দা। আগে দিনে ৮-১০ হাজার টাকা বিক্রি হতো, এখন ৪-৫শ টাকাও বিক্রি হয় না। দ্বীপে পর্যটক না থাকায় সংসার চলছে না। এমনকি অনেক সময় উপোস থাকতে হচ্ছে।’

রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার চরম অভাব-অনটনের মধ্যে দিন পার করছে

তিনি আরও জানান, ‘দ্বীপের নারকেল গাছগুলোতে সাদা পোকার আক্রমণে ডাব পাওয়া যাচ্ছে না। এখন কক্সবাজার-টেকনাফ থেকে ডাব এনে বিক্রি করতে হচ্ছে। তাতে লাভ তো দূরের কথা, খরচও উঠছে না।’

এমন গল্প হাজারও দ্বীপবাসীর। জেলে, দিনমজুর, রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হোটেল ও কটেজ শ্রমিক—সবাই আজ কর্মহীন।

চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং ১৫ এপ্রিল থেকে ১২ জুন পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনও কার্যকর সহায়তা পাননি জেলেরা। স্থানীয় জেলে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সাগরে মাছ ধরতে না পারায় আমরা পুরো পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছি। আয় না থাকায় ছেলেদের লেখাপড়ার খরচও দিতে পারছি না। আগে অন্তত পর্যটকদের ভিড়ে হোটেল বা কটেজে দিনমজুরি করে সংসার চালানো যেতো, এখন সে সুযোগও নেই।’

সেন্টমার্টিনেরই গীতিকার ও সুরকার আবদুর রশিদ বলেন, ‘শরীর খারাপ হওয়ায় মাছ ধরা ছেড়ে দিয়ে পর্যটকদের সামনে গান গেয়ে সংসার চালাতাম। সেটিও বন্ধ। এখন পরিবার নিয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে।’

জেলে, দিনমজুর, রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হোটেল ও কটেজ শ্রমিক—সবাই আজ কর্মহীন

বিকল্প কর্মসংস্থানে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার

সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীর জন্য সম্প্রতি বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালককে আহ্বায়ক করে একটি ওয়ার্কিং টিম গঠন করা হয়েছে, যার সদস্য হিসেবে রয়েছে কৃষি, মৎস্য, পর্যটন বোর্ড, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বন বিভাগ, জেলা প্রশাসন, ব্র্যাক ও কোস্ট ফাউন্ডেশন।

মে মাসের শুরুতে ব্র্যাক ও কোস্ট ফাউন্ডেশনের দুটি প্রতিনিধি দল দ্বীপ পরিদর্শন করেছে। তারা জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে।

প্রস্তাবিত বিকল্প কর্মসংস্থানের মধ্যে রয়েছে, ‘বিষমুক্ত শুঁটকি মাছের ব্র্যান্ডিং’; ‘পরিবেশবান্ধব জাল ও প্রযুক্তি ব্যবহার’; ‘সবজি ও মাশরুম চাষ’; ‘পোল্ট্রি ও গবাদিপশু পালন’; ‘নারীদের সেলাই, নকশিকাঁথা, স্মারক তৈরির প্রশিক্ষণ’; ‘নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে দড়ি তৈরি’; ‘ফটোগ্রাফি ও রেস্টুরেন্ট প্রশিক্ষণ’; ‘স্থানীয় যুবকদের ট্যুর গাইড প্রশিক্ষণ’ এবং ‘পর্যটকদের জন্য বিকল্প রুট’ প্রভৃতি।

কোস্ট ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা দেখেছি দ্বীপের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ পর্যটনের সঙ্গে জড়িত, তারা এখন সবাই বেকার। এছাড়া দ্বীপে ১৬০০-এর বেশি জেলে রয়েছেন, তারাও চরম কষ্টে আছেন।’

সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীর জন্য সম্প্রতি বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ছৈয়দ আলম বলেন, ‘দ্বীপবাসী আজ অভাব-অনটনে দিন পার করছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা হোক, কিন্তু মানুষের জীবন চলার পথ বন্ধ করে নয়। অন্তত ১০ হাজার মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে পর্যটন বন্ধ রাখা যুক্তিসঙ্গত নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমল থেকেই দ্বীপ নিয়ে নানা গুজব চলমান। এখন কর্মহীনতা সেই গুজবকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘বিকল্প কর্মসংস্থান নির্ধারণে সরকার কাজ করছে। ইতিমধ্যে দুটি প্রতিনিধি দল দ্বীপে কাজ করেছে। কোরবানির ঈদের আগে অন্তত ৯০০ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে। তবে স্থানীয়দের যাতায়াতে যাতে কোনও হয়রানি না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা হচ্ছে।’