বন্দর নগরী চট্টগ্রামে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে এক লাখের মতো চামড়া ফেলে দেওয়া হয়েছে সড়ক-ফুটপাতে। এসব চামড়া নষ্ট হয়ে রবিবার (৮ জুন) সকাল থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নষ্ট হওয়া চামড়া অপসারণ শুরু করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর আতুরার ডিপো, চৌমুহনীসহ বেশ কয়েকটি স্থানে যত্রতত্রে পড়ে আছে এসব কোরবানি পশুর নষ্ট হওয়া চামড়া।
নজরুল ইসলাম নামে এক মৌসুমি ব্যবসায়ী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার একটি মাদ্রাসা থেকে ৭০০ পিস চামড়া কিনেছি প্রতি পিস ২০০ টাকা করে। এ চামড়াগুলো রাত ১২টার দিকে আতুরার ডিপো আড়তে নেওয়ার পর কোনও আড়তদার কেনার আগ্রহ দেখায়নি। এমনকি ৫০ টাকায়ও এসব চামড়া বিক্রি করতে পারিনি। এ কারণে আতুরার ডিপো এলাকায় সড়কের পাশে এসব চামড়া ফেলে রেখেছি।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা প্রণব কুমার শর্মা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মৌসুমি ব্যবসায়ীরা নগরীর সড়ক-ফুটপাতে অন্তত এক লাখের মতো চামড়া বিক্রি করতে না পেরে ফেলে গেছে। এসব চামড়া নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। রবিবার সকাল থেকে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসব নষ্ট চামড়া অপসারণে ব্যস্ত আছে।’
রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী এলাকার বাসিন্দা মমতাজ উদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘আমরা ৩১০টি চামড়া বিক্রি করতে আতুরার ডিপো এলাকায় অবস্থিত আড়তে যাই। তখন রাত সাড়ে ৮টা। তখনও কোনও আড়তদার চামড়া কেনায় আগ্রহ দেখায়নি। শেষ পর্যন্ত ৩১০ পিস চামড়া ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। প্রতি পিস চামড়া ৮০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এ চামড়াগুলো ট্রাক ভাড়া, শ্রমিক খরচ বাবদ খরচ হয় ১২ হাজার টাকা।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীতে শনিবার (৭ জুন) রাত ৯টার পর আড়তদারগণ চামড়া কেনা বন্ধ করে দেয়। এরপরও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে রবিবার ভোরেও ট্রাকে ট্রাকে চামড়া আসে আড়তগুলোতে। এতে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে সড়ক-ফুটপাতে ফেলে চলে যায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
মো. হানিফ নামে এক মৌসুমি ব্যবসায়ীর অভিযোগ, আড়তদারগণ কম দামে চামড়া কিনতে সিন্ডিকেট করেছে। যে কারণে শুরু থেকে তাদের চামড়া কেনায় আগ্রহ কম ছিল। আড়তদার সিন্ডিকেটের কারণেই মূলত এতগুলো চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা প্রতি পিস চামড়া ৬০০, ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০ টাকায়ও কিনেছি। আমরা কোন সিন্ডিকেট করিনি। কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছে। কারণ আজ সকালে অনেকে চামড়া নিয়ে এসেছে। দেরিতে আনার কারণে অনেক চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘মৌসুমি বিক্রেতাদের বারবার সতর্ক করা হয়েছে। সরকার শুধু লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে, কাঁচা চামড়ার নয়। কিন্তু অনেকে এই বিষয়টা না বোঝায় নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেন, সেটিকে লবণযুক্ত করতে অনেক টাকা খরচ হয়। একটি ২০ ফুটের চামড়ায় প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন ও আড়তের খরচসহ প্রায় ৫০০ টাকা খরচ পড়ে। এ ছাড়া ট্যানারি মালিকরা প্রতি চামড়ার ২০ শতাংশ বাদ দেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক সময় সমিতির আওতাভুক্ত ১২০ জন আড়তদার কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করতেন। লোকসানসহ নানা কারণে গত কয়েক বছরে পেশা ছেড়েছে অসংখ্য আড়তদার। বর্তমানে ৩০ জনের মতো আড়তদার কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করছেন।’
স্বাধীনতার আগে চট্টগ্রামে ট্যানারি শিল্প ছিল ৩০টি। স্বাধীনের পরও ২২টি জিইয়ে ছিল। ৮০-৯০ এর দশকের পর ধুঁকে ধুঁকে সব কটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে রিফ লেদার লিমিটেড নামে একটি ট্যানারি চালু রয়েছে।
রিফ লেদারের পরিচালক মোখলেছুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এত চামড়া নষ্ট হওয়া ভালো লক্ষণ নয়। সরকার আগে থেকে চামড়ার দাম এক হাজার টাকা থেকে ১২০০ টাকা বলে দেওয়াটা সঠিক হয়নি। বেশি দামে বিক্রির আশায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ করে কম দামে বিক্রি করেছে। এতে লোকসানে পড়তে হয়েছে তাদের। একইভাবে চট্টগ্রামে একসময় ১০০ থেকে ১৩০ জন আড়তদার ছিল। বর্তমানে তা কমে ২৮ থেকে ৩০ জন আড়তদার আছে। তাদের একটা সক্ষমতা আছে। এসব চামড়া প্রসেস করতে লোকবল প্রয়োজন, রাখার জন্য স্থান প্রয়োজন। পাশাপাশি চামড়া কিনতে পর্যাপ্ত অর্থ প্রয়োজন। আড়তদারদের নির্দিষ্ট টার্গেট শেষ হলে তারা চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখাবে না। এ কারণে উপজেলা এবং মাদ্রাসাগুলোতে চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে চামড়া নষ্ট হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।’
তিনি বলেন, ‘কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ করেন। এরপর তারা আড়তদারদের কাছে চামড়া বিক্রি করেন। আড়তদারদের মাধ্যমে আমরা ট্যানারিগুলো চামড়া পেয়ে থাকি।’