শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সাবেক সেনাসদস্যসহ ৫ সন্ত্রাসী গ্রেফতার, র‍্যাবের পোশাক উদ্ধার

কক্সবাজারে র‍্যাবের ১৩ দিনের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সামরিক বাহিনীর বহিষ্কৃত সৈনিকসহ পাঁচ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১৫ সদস্যরা। এ সময় র‍্যাবের পোশাক ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সোমবার (৩০ জুন) দুপুরে র‌্যাব-১৫ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‍্যাবের অধিনায়ক লে. কর্নেল কামরুল ইসলাম।

কামরুল ইসলাম জানান, দীর্ঘদিন ধরে টেকনাফ ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে একটি সন্ত্রাসী অপহরণ চক্র বিভিন্ন জনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে আসছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব সদস্যরা কক্সবাজারের টেকনাফের পাহাড় কেন্দ্রিক অপহরণ চক্রের মূলহোতা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবি হোসেন ও স্থানীয় ডাকাত চক্রের প্রধান শাহ আলমকে ধরতে মাঠে নামে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে ২০১৯ সালে বহিষ্কৃত সৈনিক সুমন মুন্সীসহ একটি চক্রে র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর প্রকাশ্যে আসে চক্রের প্রধান দুই জনের নাম। এর থেকে র‌্যাব ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে গত ১৩ দিনে সেনাবাহিনীর ওই বহিষ্কৃত সৈনিক সুমনসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে। একই সঙ্গে র‍্যাবের পোশাকসহ বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করেছে।

তিনি জানান, র‍্যাবের ধারাবাহিক অভিযানের অংশ হিসেবে সর্বশেষ রবিবার (২৯ জুন) কক্সবাজারের উখিয়ার মরিচ্যা এলাকার নিজ বাড়ি থেকে সন্ত্রাসী ফারুককে গ্রেফতারের পর সোমবার এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে র‌্যাব। গ্রেফতার জায়েদ হোসেন ফারুক (২২) উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের মরিচ্যা এলাকার আবদুস শুক্কুরের ছেলে। অভিযানে অপহরণে ব্যবহৃত চারটি র‍্যাবের পোশাক, একটি র‍্যাবের ফেইক আইডি কার্ড, একটি হ্যান্ডকাপ, একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি দেশি অস্ত্র, ১০ রাউন্ড তাজা অ্যামুনেশন, ১১ রাউন্ড এমটি কার্টিজ ও একটি চাকু উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে বহিষ্কৃত সৈনিক সুমন মুন্সী ছাড়াও আফ্রিদি, আব্দুল গফুর, শিকদার ডাকাতকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছিল।

সংবাদ সম্মেলনে কামরুল ইসলাম জানান, গত ১১ জুন রাত ১১টায় ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে রহিমুল্লাহর ছেলে হাফিজ উল্লাহকে র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণ করে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। রোহিঙ্গা এনায়েত উল্লাহ ও নবী হোসেনের সহায়তায় ভিকটিমকে নিজ বসতঘর হতে ডেকে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গিখালী গহীন পাহাড়ে নিয়ে যায় চক্রটি। পরে অপহৃতের পরিবারের কাছে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তারা। এই খবর পেয়ে র‌্যাব-১৫ ভিকটিমের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ জুন বিকালে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‍্যাবের একটি চৌকসদল রঙ্গিখালীতে অপহরণের অন্যতম প্রধান হোতা ডাকাত সর্দার শাহ আলমের বাড়িতে হানা দিয়ে আফ্রিদি ও আব্দুল গফুর নামে দুই সন্দেহভাজনকে আটক করতে সক্ষম হয়।

তিনি বলেন, এরপর শনিবার বিকালে উখিয়ার মরিচ্যা বাজার থেকে বরখাস্ত সৈনিক সুমন মুন্সিকে গ্রেফতার করে। এরপর  সুমনের মাধ্যমে অপহরণকারী ডাকাত শাহ আলম, সন্ত্রাসী রাকিব ও সন্ত্রাসী শিকদারকে ভুক্তভোগী হাফিজ উল্লাহকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বার্তা পাঠানো হয়। আহ্বানে সাড়া দেয়নি চক্রটি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগীকে উদ্ধারের জন্য ১৫ জুন র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ, এপিবিএন ও বনবিভাগের ২৫৬ জন জনবল নিয়ে ভিকটিমকে আটকে রাখার সম্ভাব্য গহীন অরণ্যে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে। এক পর্যায়ে অপহরণের ৭২ ঘণ্টা পরে ভুক্তভোগী হাফিজ উল্লাহকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে একটি দেশীয় অস্ত্র, তিন রাউন্ড অ্যামুনেশনসহ র‍্যাবের ইউনিফর্ম ও ওয়াকিটকি উদ্ধার করা হয়েছে।

এ ঘটনায় র‌্যাব বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় মামলা করা হয় জানিয়ে লে. কর্নেল কামরুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় জড়িতে ধরতে র‌্যাব ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে। অভিযানে অংশ হিসেবে অপহরণের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কুখ্যাত ডাকাত শিকদারকে রবিবার গ্রেফতার করা হয়। শিকদারের দেওয়া তথ্যমতে সন্ত্রাসী ফারুককে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারি যে, বরখাস্ত সৈনিক সুমন কয়েক বছর আগে মিরপুরের শাহ আলী মার্কেট থেকে র‍্যাবের ইউনিফর্মগুলো তৈরি করেছে। সন্ত্রাসীরা বর্ণিত ইউনিফর্মগুলো ব্যবহার করে নানা সময়ে র‍্যাবের পরিচয়ে অপহরণ করে আসছিল। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ব্যবহৃত পোশাক ব্যক্তিগতভাবে তৈরি এবং ব্যবহার করা গুরুতর অপরাধ।

তিনি দেশের সব টেইলার্স ও পোশাক প্রস্তুতকারী কোম্পানিদের সতর্ক করে এ ধরনের অপরাধ থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানান এবং অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও জানান, হাফিজুল্লাহ অপহরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীদেরকে গ্রেফতার করতে পারলেও এখনো রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন ও কুখ্যাত ডাকাত শাহ আলমসহ কয়েকজন ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। পলাতক সন্ত্রাসীদের ধরার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

র‌্যাব ও পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, টেকনাফ উপজেলার পাহাড় কেন্দ্রিক অপহরণ চক্রের আলোচিত নাম আবুল আলম ও শাহ আলম দুই সহোদর। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গিখালি এলাকার গাজীপাড়া গ্রামের আবদুল মজিদ প্রকাশ ভোলাইয়া বদ্দ্যের ছেলে দুই জন। যার মধ্যে আবুল আলমের (৪২) বিরুদ্ধে অস্ত্র, অপহরণ, মানবপাচার মাদকসহ নানা আইনে রয়েছে ৩০টির বেশি মামলা। শাহ আলমের (৩৬) বিরুদ্ধে একই ধরনের অপরাধে ২৮টির বেশি মামলা রয়েছে। তারা দুই ভাই দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে টেকনাফের পাহাড় কেন্দ্রিক একটি বাহিনী পরিচালনা করে ডাকাতি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, নির্যাতনসহ নানা অপরাধ করে আসছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে নবি হোসেন সহ চিহ্নিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী এবং স্থানীয় অপরাধীরা।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের তথ্য বলছে, এ নিয়ে গত সাড়ে ১৭ মাসে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৫৬ জন অপহরণের ঘটনা ঘটেছে।