বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) বেলা সোয়া ১২টার দিকে মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত দায়রা জজের আদালতে আসামি জামির হোসেনকে রায় পড়ে শোনানো হয়। আলোচিত এই মামলার ৫৫ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা করেন মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক আল মাহমুদ ফায়জুল কবীর। বিচারক রায় পড়ার সময় আসামি জামির উপস্থিত ছিলেন। তবে বাদী পক্ষের কেউই উপস্থিত ছিলেন না।
আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৪২৭ ধারার অভিযোগ সন্দেহাতীত প্রমাণিত হয়। দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর দণ্ডবিধি ৪২৭ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও দুই হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে।
মামলার রায়ে বিচারক উল্লেখ করেছেন, মামলাটির তদন্তের সময় প্রকাশ পায় আসামি জামির হোসেনের ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ দুর্ঘটনার তিন বছর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, অবৈধ উপায়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের একটি ভুয়া নবায়ন স্লিপ ব্যবহার করে দীর্ঘদিন গাড়ি চালাচ্ছিলেন জামির হোসেন। এছাড়া বাসের যান্ত্রিক ত্রুটিও ছিল। বিআরটিএ’র বেঁধে দেওয়া গতির চেয়ে বেশি গতিতে বাসচালক চালাচ্ছিলেন তিনি। বাসটির ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না বলেও উল্লেখ করা হয় রায়ে।
এরই মধ্যে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের মোট ২৪ জন এবং আসামিপক্ষের দুইজন সাফাই সাক্ষী নেন আদালত।
কান্নায় ভেঙে পড়েন আসামি
আলোচিত এই রায়কে কেন্দ্র করে মানিকগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী, সাংবাদিক ও উৎসুক জনতার ভিড় ছিল উপচে পড়া। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আসামি জামিরকে নেওয়া হয় মানিকগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকের কামরায়। বিচার আল- মাহমুদ ফাইজুল কবীর ৫৫ পৃষ্ঠার রায় আসামির সামনে পড়েন। রায় ঘোষণা শেষে আসামি জামির হোসেনকে হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আদালতের হাজতখানায়। তখন তিনি কাঁদছিলেন। পরে কড়া নিরাপত্তা দিয়ে তাকে পাঠানো হয় মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে। জামির হোসেন চুয়াডাঙ্গা জেলার দৌলতদিয়া স্কুল পাড়া গ্রামের আব্দুর রহিম বিশ্বাসের ছেলে।
মামলা ও গ্রেফতার হয় যেভাবে
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার শালজানা গ্রামে কাগজের ফুল ছবির শুটিং স্পট দেখে ঢাকা ফিরছিলেন খ্যাতিমান চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ছেলে এটিএন নিউজের প্রধান নিবার্হী মিশুক মুনীরসহ আরও কয়েকজন। বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোকা এলাকায় প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের সঙ্গে বিপরীতমুখী চুয়াডাঙ্গাগামী চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, মাইক্রোবাস চালক মোস্তাফিজুর রহমান, প্রোডাকশন সহকারী মোতাহার হোসেন ওয়াসিম ও জামাল হোসেন নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, শিল্পী ঢালী আল-মামুন ও তার স্ত্রী দিলারা বেগম জলি এবং তারেক মাসুদের সহকারী মনীশ রফিক আহত হন।
এই দুর্ঘটনার পর ঘিওর থানার তৎকালীন এসআই লুৎফর রহমান বাদী হয়ে ঘিওর থানায় মামলা দায়ের করেন। দুর্ঘটনার পরের দিন বাস চালক জামির হোসেনকে মেহেরপুরে এক আত্মীয়ের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তৎকালীন ডিবি ইন্সপেক্টর আশরাফ-উল ইসলাম মামলার তদন্ত করে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসচালক জামির হোসেনের বিরুদ্ধে ২৭৯, ৩৩৭, ৩৩৮(ক), ৩০৪ ও ৪২৭ ধারায় আদালতে চার্জশিট জমা দেন।
এ মামলায় আসামিপক্ষের দুইজন সাফাই সাক্ষীসহ মোট ২৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। দীর্ঘ সাড়ে ৫ বছর শুনানির পর উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক আল-মাহমুদ ফাইজুল কবীর আজ এই রায় দেন।
রায়ের আগে আসামির দম্ভ
রায়ের আগে আদালত প্রাঙ্গণে আসামি জামির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি কোনও অপরাধ করেননি। তবে দুর্ঘটনায় ৫ জনের প্রাণহানিতে তিনি অনুতপ্ত। দুর্ঘটনার সময় তিনি রাইট পয়েন্টে ছিলেন আর মাইক্রোবাসটি রং সাইডে ছিলেন। তিনি রায় নিয়ে মোটেও বিচলিত নন। ওই সময় জামির হোসেন দাম্ভিকতা করা বলেন, ‘আমিতো মারিনি। বরং সাংবাদিক বহনকারী মাইক্রোবাসটি কাঁপতে কাঁপতে আমার গাড়ির ওপর আঘাত করলে দুর্ঘটনাটি ঘটে।’
উল্লেখ্য গ্রেফতারের পর মাত্র তিন মাস কারাগারে ছিলেন জামির হোসেন। তিনি জামিনে মুক্তি পান ২০১১ সালের ১৭ নভেম্বর। এর পর থেকে জামিনেই রয়েছেন জামির হোসেন।
আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া
আসামিপক্ষের আইনজীবী মাধব সাহা সাংবাদিকদের জানান, এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। রায়ে তিনি অসন্তুষ্ট।
মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আদনান জানান, রায়ে তারা সন্তুষ্ট। দেশের কীর্তিমান ব্যক্তিদের নিহতের ঘটনায় এই রায়ই হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
রায় ঘোষণার সময় বাদী পক্ষের কোনও লোকজন উপস্থিত ছিলেন না। তবে চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মানিকগঞ্জের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মো. ইকবাল হোসেন কচি ও তারেক মাসুদের প্রোডাকশন হাউজের সহকারী মো.শহিদুল ইসলাম আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের জানান, দীর্ঘ দিন পরে হলেও এই রায়ে তারা খুশি হয়েছেন। তারা বলেন, ‘আমরা যাদের হারিয়েছি তাদেরকে কোনও দিনও ফিরে পাবো না। তাদের হারিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।’
শহীদুল ইসলাম জানান, তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ এখন আমেরিকায় রয়েছেন। তার বাবার মৃত্যুতে তিনি সেখানে গেছেন।
উল্লেখ্য, মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনার পর ঢাকা-আরিচা মহাড়কের ২১টি স্পটকে ব্ল্যাক স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরপর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় করা হয় ডিভাইডারসহ চার লেন।
/এফএস/টিএন/
আরও পড়ুন-
‘ফের এমপি হওয়া লোভ থেকেই লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন কাদের’