‘ডালিমের ঘোষণা, মানি না মানবো না’ স্লোগানে প্রথম প্রতিবাদ কিশোরগঞ্জে

রাত পোহানোর আগেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার দুঃসংবাদটি জেনে যান অনেকে। তাই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সকালটি কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে আর দশটি সকালের মতো ছিল না। এক অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে থমথমে শহরে। এসবের তোয়াক্কা না করে কয়েকজন সাহসী যুবক রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। মুজিব হত্যার প্রতিবাদ জানান তারা। মিছিল নিয়ে ঘুরে বেড়ান পুরো শহর।

এখান থেকেই সেদিন শুরু হয়েছিলো প্রতিবাদী মিছিলসেই বিক্ষুব্ধ সকালটি যেভাবে রচিত হলো
সকাল নয়টার দিকে কিশোরগঞ্জ শহরের স্টেশন রোডে জেলা ছাত্র ইউনিয়নের অফিস থেকে শুরু হয় মিছিলটি। পুরান থানা, একরামপুর, বড়বাজার, ঈশা খাঁ রোড, আখড়াবাজার, কালীবাড়ী মোড় হয়ে থানার সামনে দিয়ে শহর ঘুরে রঙমহল সিনেমা হলের সামনে গিয়ে শেষ হয় মিছিল। সেদিন ছাত্র-যুবকদের কণ্ঠে স্লোগান ছিল, ‘মুজিব হত্যার পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম’, ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে, লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে’, ‘ডালিমের ঘোষণা, মানি না, মানবো না।’

সংখ্যায় ওরা ছিল ২০ থেকে ২২জন। তাদের বেশিরভাগই ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মী। তারা সবাই বয়সে তরুণ, কেউ কেউ আবার স্কুল-কলেজের ছাত্র। বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন তাদের মধ্যে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে মিলিত হন তারা। সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে দিতে হবে দেশজুড়ে। মিছিল শেষে ছাত্র-যুবকরা যখন অফিসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল, ঠিক তখন এক ট্রাক পুলিশ গিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

এ রাস্তাতেই হয়েছিলো বিক্ষোভ মিছিলসেই সময়ের টগবগে যুবক মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান মুক্তও অংশ নিয়েছিলেন ওই প্রতিবাদ মিছিলে। তিনি জানান, ১৫ আগস্ট ভোরে আব্বা আমাদের সবাইকে ডেকে তুলে আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় জানান, শেখ সাহেবকে মেরে ফেলা হয়েছে। বাসায় একটি রেডিও ছিল। সেই রেডিও চালিয়ে আমরা সবাই হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হই। কিছুক্ষণের মধ্যে অশোক সরকার আমাদের বাড়িতে আসে। তার সঙ্গে আমি রঙমহলের সামনে চলে যাই। সেখান থেকেই আমরা তাৎক্ষণিকভাবে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করি।

মিছিলে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের একজন মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট অশোক সরকার। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুসংবাদ শোনার পর কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। অন্যদিকে ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে শহরে। কয়েকজন বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তাদের গোপনে সংগঠিত রঙমহলের ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে এসে অবস্থান নিয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যত বাধাই আসুক আমরা প্রতিবাদ মিছিল করবো এবং শেষ পর্যন্ত আমরা মিছিলটি বের করি।’

মিছিলের আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগযোগ করেছিলেন যুবকরা। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনও দিক-নির্দেশনা পাননি মিছিলকারীরা বরং আওয়ামী লীগ নেতাদের দোদুল্যমন্যতা হতাশ করে তাদের। মিছিলের পর ছত্রভঙ্গ যুবকরা দীর্ঘদিন প্রত্যন্ত এলাকায় আত্মগোপনে ছিলেন। তবে যেখানে ছিলেন, সেখানেই এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ করে জনমত গঠনের চেষ্টা করেছেন তারা।

আরেক প্রতিবাদকারী পিযুষ সরকার বলেন, ‘জাতির জনককে হত্যার পর ঢাকায় যে নীরবতা বিরাজ করছিল, তা দেখে আমাদের কষ্ট হচ্ছিল। দেশের স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যার পর আমরা কিভাবে চুপ করে থাকি! বিবেকের তাড়না থেকেই জীবন বাজি রেখে সেদিন প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেদিনের মিছিলে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা কেউ অংশ নেননি। তারা নীরব ভূমিকা পালন করে বাসায় বসে ছিলেন।’

সেই তেজোদীপ্ত প্রতিবাদী যুবকরা এখন কেউ ডাক্তার, কেউ আইনজীবী, কেউ শিক্ষক, কেউ ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ কিংবা লেখক। সবাই বেঁচেও নেই, যারা আছেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেওয়ার কথা স্মরণ করে আজও তারা গর্ববোধ করেন। তারা মনে করেন, চেতনাই সেদিন তাদের মিছিলে টেনেছিল। ওই মিছিল ছিল তাদের অনিবার্য গন্তব্য। আজ চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই, কেবল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশটা দেখে মরতে চান। তাদের দাবি, জাতির জনকের পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হোক।

/এমপি/এমও/