কিশোরগঞ্জের আট উপজেলা চালান নারী ইউএনওরা

কিশোরগঞ্জ জেলার আট নারী ইউএনও
কিশোরগঞ্জের ১৩ উপজেলার মধ্যে আটটিতেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। তারা উপজেলা প্রশাসনের সবচেয়ে বড় পদে (ইউএনও) কাজ করছেন। নারী জাগরণের পতাকা হাতে উন্নয়ন আর অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন নিজের এলাকাকে। নারীর মমতায় গড়ে তুলেছেন জনবান্ধব প্রশাসন।

কিশোরগঞ্জের আট উপজেলায় জনবান্ধব প্রশাসনের নেতৃত্বদানকারী নারীরা হলেন, করিমগঞ্জে মাহমুদা, তাড়াইলে সুলতানা আক্তার, পাকুন্দিয়ায় অন্নপূর্ণা দেবনাথ, কটিয়াদীতে ইসরাত জাহান কেয়া, মিঠামইনে তাসলিমা আহমেদ পলি, বাজিতপুরে সোহানা নাসরীন, কুলিয়ারচরে ড. ঊর্মি বিনতে সালাম ও ভৈরবে দিলরুবা আহমেদ। তারা সবাই ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এক সময় মানুষের কাছে প্রশাসন ছিল ‘আতঙ্কের’ নাম। নারীর মমতায় আর সহযোগীতার প্রশাসন এখন সাধারণ মানুষের কাছাকাছি। একেক জন একেক ধরণের অগ্রাধিকার নিয়ে কাজ করছেন, কেউ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, কেউ নারীর উন্নয়ন, কারও অগ্রাধিকার মাদক নির্মূল ও কর্মসংস্থান। কেউ অগ্রাধিকার দিচ্ছেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে। সব মিলিয়ে তারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

23897712_1374069262702429_960495825_n
তাড়াইল উপজেলা নির্বহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুলতানা আক্তার বলেন,‘তাড়াইল একটি দুর্গম হাওর বেষ্টিত উপজেলা যেখানে শিক্ষার হার খুব বেশি না, সেখানে একজন নারী ইউএনও হিসেবে কাজ করছেন, এলাকার মানুষের কাছে এটা নতুন, কারণ তারা এটা দেখে অভ্যস্ত না। তাই প্রথম প্রথম এলাকার মানুষের মধ্যে একটা প্রশ্ন কাজ করাতো, উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ যে কোনও সিদ্ধান্ত বা দিক নির্দেশনা আমি দিতে পারবো কিনা? আল্লাহর রহমতে আমি আমার কাজের মধ্যে দিয়ে এবং সবার সহযোগিতায় তাদের সেই ধারণাটি পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি। এ অঞ্চলে নারী-পুরুষ সবাই অনেক পিছিয়ে আছে। এরমধ্যে নারীদের অবস্থা খুবই নাজুক। আমি নারীদের সাবলম্বী করতে এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। যেমন আশ্রয়ানের ঘরগুলো বরাদ্দের ক্ষেত্রে আমারা নারীদের অগ্রাধিকার দিয়েছি। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পেও ৬০ শতাংশ নারী।’
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের হাওর অধ্যুষিত মিঠামইন উপজেলার লোকজন কখনও নারী ইউএনও দেখেনি। এই দুর্গম এলাকায় দিনের পর দিন কাজ করছেন তাসলিমা আহমেদ পলি। তিনি এ উপজেলার প্রথম নারী ইউএনও। যেখানে পুরুষ কর্মকর্তারাই থাকতে চান না সেখানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন।

23845292_1374069269369095_1388794244_n
অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘দশ মাস হলো আমি এ উপজেলায় ইউএনও হিসেবে যোগদান করেছি। মিঠামইনে আমিই প্রথম নারী ইউএনও। একজন নারী যে ইউএনও হতে পারে সেটা এখানকার মানুষ কখনও ভাবেনি। আমি যখন বিভিন্ন ইউনিয়ন বা এলাকায় যাই তখন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আমাকে দেখতে আসেন। যখন আমি স্কুলে যাই বাল্যবিবাহ বা বিভিন্ন প্রোগ্রাম নিয়ে কথা বলি তখন মেয়েরা উৎসাহিত হয়। এই দুর্গম উপজেলায় যেখানে একজন পুরুষ কর্মকর্তা থাকতে চান না সেখানে আমি আছি এবং ভালো আছি। আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না বরং সবাই আমাকে সহযোগিতা করছে।’
জেলার পাকুন্দিয়ার স্থানীয় রাজনীতিতে বিরোধ থাকলেও অন্নপূর্ণা দেবনাথ ইউএনও হিসেবে যোগদানের পর এইসব বিরোধ অনেকটাই কমে গেছে। সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করে কাজ করতে পছন্দ করেন তিনি। সেই সুফলও ভোগ করছে এলাকাবাসী। অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে পাকুন্দিয়া উপজেলা প্রশাসন এখন অনেক বেশি গতিশীল, কর্মচঞ্চল ও স্বচ্ছ।
অন্নপূর্ণা দেবনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে কোনও বিষয় সমন্বয়ের ক্ষেত্রে একজন পুরুষ কর্মকর্তার চেয়ে নারী হিসেবে আমি একটু বেশি সুবিধা পাচ্ছি। কারণ সবাই তাদের যে কোনও সমস্যার কথা আমাকে অনায়াসে বলছে। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া নারীরা। তাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি তারা আমাকে খুব আপন ভেবে নিয়েছে। যে কারণে আমার কাজ করতে সুবিধা হচ্ছে। এছাড়াও জেলা প্রশাসক সব সময় আমাদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। আমিও কাজের মাধ্যমে যথাসাধ্য নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করছি।’

23845065_1374069266035762_338748232_n
এ ছাড়াও কুলিয়ারচরের ইউএনও ড. ঊর্মি বিনতে সালাম বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্লাসের আয়োজন করে সুনাম কুড়িয়েছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। ভৈরবের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিলরুবা আহমেদ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কাজ করছে। আর অসীম সাহস নিয়ে লড়ছেন মাদকের বিরুদ্ধে। কটিয়াদীর ইউএনও ইসরাত জাহান কেয়া ও বাজিতপুরের ইউএনও সোহানা নাসরিন সম্প্রতি ইউএনও হিসেবে যোগ দিলেও ভালো কাজের জন্য এরইমধ্যে তারা এলাকায় প্রশংসিত হয়েছেন। অন্যদিকে করিমগঞ্জের ইউএনও মাহমুদা মাত্র ছয় মাসেই প্রশাসনে জবাবদিহিতা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন।
ইউএনও’র দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পরিবার কিছুটা বঞ্চিত হলেও দেশ ও এলাকার স্বার্থে সেই কষ্টটুকু তারা হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
নারী ইউএনওরা তাদের কাজে সৃজনশীলতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস বলেন, ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নানামুখী কাজ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে আমি বলবো এ জেলায় কর্মরত আট নারী ইউএনও কোনও ধরনের সংকোচ ছাড়াই আস্থা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষও তাদের ওপর খুব খুশি। জেলা প্রশাসক হিসেবেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কার্যক্রম তদারকি করা আমার দায়িত্ব। তারা যেন সাচ্ছন্দে ও সঠিকভাবে কাজ করতে পারে সে ব্যাপারে আমি সহযোগিতা করছি। এ জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে ৮টি উপজেলায় নারী ইউএনও ভালোভাবে ও সফলতার সঙ্গে কাজ করায় অন্য নারীরাও উৎসাহিত হবে। নারীর অগ্রগতিতে এই আট কর্মকর্তা মাঠ প্রশাসনের কঠিন দায়িত্ব পালন করছে। যা অন্য অন্য নারীদের যে কোনও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সাহস যোগাবে।

আরও পড়ুন: ফেনীর তিন ইউনিয়নে ২৮ ডিসেম্বর উপ-নির্বাচন