বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল তাদের অনুপ্রেরণা

01বাংলাদেশে ৬৭৬ জন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন গোপালপুরের শহিদুল ইসলাম লালু। তিনি মাত্র ১২ বছর বয়সে স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। জেলার দেলদুয়ার উপজেলার আব্দুল খালেক, আব্দুল মজিদ, মজিবর রহমান নামে তিন মুক্তিযোদ্ধা। যাদের একটি আলোচিত ছবি আজ দেশের ঘরে ঘরে। জেলার বাসাইলে রয়েছে নুরে আলম তালুকদার রবি। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণে তার রয়েছে আলোচিত আরেকটি ছবি। তারা পাঁচ জনই বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৭ মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত ছবিগুলোর মধ্যে খালেক, মজিদ ও মজিবরের সমন্বয়ে তোলা ছবিটি অন্যতম। ছবির তিন মুক্তিযোদ্ধা দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন ইউনিয়নের মুশুরিয়া গ্রামের। ওপরে গ্রেনেড ছুড়ছেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক। মাঝে রাইফেল হাতে আব্দুল মজিদ। বামে মজিবর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আলোচিত ছবিটি।

১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের সম্ভুগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের একটি শক্ত ঘাঁটির বাংকার ধ্বংসের চিত্রটি ক্যামেরাবন্দি করেন মানিকগঞ্জের নাইব উদ্দিন নামে এক ফটোগ্রাফার। মুক্তিযুদ্ধে এই তিন বীরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লেও ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি একটি দৈনিকে ছবিটি প্রকাশের পর জানা যায় ওরা বেঁচে আছেন। আব্দুল খালেক, মজিবর রহমান ও আব্দুল মজিদ মুশুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা।

আব্দুল খালেক জানান, তারা তিন বন্ধুই তখন ১৩/১৪ বছরের কিশোর। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে প্রেরণা পেয়ে যুদ্ধে নামেন। প্রথমে মনে করেন সেনাবাহিনী পারবে দেশকে মুক্ত করতে। অনিশ্চয়তা দেখে সমবয়সীদের সংঘবদ্ধ করতে থাকেন তারা। মে মাসের শেষ দিকে তারা ২১ জন বন্ধু মিলে নৌকায় ইন্ডিয়ার মাইনকার চরে যান। তিন দিন পর তাদের মেডিক্যাল হয়। তুরা ক্যাম্পে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। সেখানে আলফা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে ২১ দিন ফ্রন্টফাইটার অতঃপর সাত দিন গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে প্রায় ৭শ’ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা দেশে ফেরেন। তাদের কৌশল ছিল, সুযোগ বুঝে শত্রুদের ওপর আকস্মিক হামলা, পরক্ষণেই ইন্ডিয়াতে আত্মগোপন করা। কিছুদিন পর সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে শুরু করে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। ৭১’র ৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী (ইন্ডিয়ান আর্মি ৬ বিহার) রেজিমেন্টের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামেন। পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গুলির পাশাপাশি ধ্বংস করেন শত্রুদের বেশ কয়েকটি ঘাঁটি।

02মুক্তিযোদ্ধার লম্বা তালিকা দেখে আব্দুল খালেক বলেন, ‘তখন যদি এত মুক্তিযোদ্ধা থাকতো তাহলে স্বাধীন হতে ইন্ডিয়া-রাশিয়ার প্রয়োজন হতো না। এখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে দেশ যেমন স্বাধীন হতো না তেমনি টাঙ্গাইল না থাকলে এতো মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যেত না।’ মুক্তিযুদ্ধে অবদান ও কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ভাগে সম্মাননা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।

এদিকে মজিবর ২০১৪ সালে মারা যান। তার স্ত্রী সাহাতন বেগম জানান, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার স্বামী মারা যান। তার চার ছেলে রয়েছে। আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবিকার খোঁজে রিকশা চালাতে হয়েছে মজিবরকে। অন্য সন্তানরা কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেলেও সরকার ছোট ছেলে রনির কর্মসংস্থানের বিষয়টি দেখবেন এমন প্রত্যাশা তার। আব্দুল মজিদ ব্যাটালিয়ন আনসারে কর্মরত ছিলেন। আলোচিত ছবির এই তিন যোদ্ধাকে স্মরণীয় করে রাখতে উপজেলাতে সরকারিভাবে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ হবে এমনটাই দাবি স্থানীয়দের।

৭১’র সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা লালু 

গোপালপুর পৌর শহরের সূতীপলাশপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের ছেলে শহিদুল ইসলাম লালু। ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গোপালপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ফায়ারিং শুরু হলে স্থানীয়রা এলাকা ছাড়তে শুরু করে। লালুও সঙ্গে যায়। তার সঙ্গে ধনবাড়ির কেরামজানী স্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় হয়। কমান্ডার কাজী হুমায়ুন আশরাফ বাঙ্গাল ও আনোয়ার হোসেনের হাত ধরে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে চলে যান লালু। মুক্তিযোদ্ধাদের চা-পানি খাওয়ানোর পাশাপাশি অস্ত্র পরিষ্কারের কাজ করতেন। এভাবেই অস্ত্র ধরা শেখেন কিশোর লালু। সপ্তাহ খানেক পর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণে ভারত চলে যান। ভারতে স্টেনগান ও গ্রেনেড পান। আর পোশাক হিসেবে হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি ও ক্যাপ।

ভারতের তুরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণকালে ব্রিগেডিয়ার সামসিং শহিদুল ইসলামের নামের সঙ্গে লালু নামটি যুক্ত করেন। সেই থেকে শহিদুল ইসলামের নাম হয়ে যায় শহিদুল ইসলাম লালু। এই লালু ভারতের তুরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলাকালীন প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা হুইসেল বাজিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে জাতীয় সংগীত গেয়ে পতাকা উঠাতেন ও নামাতেন।

লালু স্টেনগান ও গ্রেনেড বিষয়ে ভালো শিক্ষা নিয়ে চলে আসেন গোপালপুরের কেরামজানীতে। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গোপালপুর থানার পাকিস্তানি হানাদার বাংকার গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার। লালু হাফপ্যান্ট পড়ে বিকালে তিনটি গ্রেনেড নিয়ে গোপালপুর থানার সামনে যেতেই পরিচিতদের সঙ্গে দেখা। সেখানে রাজাকারও ছিল। এসময় বাংকারে পাঞ্জাবী সেনাদের ক্যাম্পে চা খাওয়ানোর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় লালু। গ্রেনেড তিনটি থানার পেছনের পুকুর পাড়ে রেখে ক্যাম্পে প্রবেশ করে। লালু ছোট হওয়ায় সহজেই লুকিয়ে রাখা গ্রেনেডগুলো আনেন। পরে খুলে দ্রুত প্রত্যেক বাংকারের দিকে ছুড়ে মারেন। এতে তিনটি বাংকারের সবাই মারা যায়।

১৯৭২ সারের ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে যখন টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী স্কুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কাদেরিয়া বাহিনীর সব মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র জমা দিচ্ছিলেন, তখন শহীদুল ইসলাম লালুও তার ব্যবহৃত স্টেনগানটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু অবাক হয়ে লালুর পিঠ থাপড়ে বলেছিলেন শাব্বাশ। যখন সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে লালুর বাংকার ধ্বংসের কথা শুনলেন তখন বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে কোলে নিয়ে বলেছিলেন ‘বীর বিচ্ছু’।

03শহিদুল ইসলাম লালু সশস্ত্র বাহিনী দিবস ২০০০, আজীবন সংবর্ধনা ২০০৩, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া কর্তৃক পুরস্কার ও আর্থিক অনুদান, মিশরের রাষ্ট্রদূত কর্তৃক পুরস্কারসহ আরও অনেক খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। শহিদুল ইসলাম লালু ২০০৯ সালের ২৫ মে ঢাকার মিরপুরে নিজ বাসভবনে মারা যান। পরে মিরপুরেই তাকে সমাহিত করা হয়।

এদিকে আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা নুরে আলম বাসাইল উপজেলার ফুলকী ইউনিয়নে জশিহাটী গ্রামের মৃত ইউসুফ তালুকদারের ছেলে। নুরে আলমও শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনে যুদ্ধে যেতে অনুপ্রাণিত হয়। কমান্ডার সাইদুর রহমান বীরপ্রতীকের হাত ধরে যোগ দেন কাদেরিয়া বাহিনীতে। প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান ভারতের মেঘালয়ে। ১৬ বছর বয়সী নুরে আলম দেড়মাস প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখেন।

নুরে আলম জানান, ৭১-এ এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন তিনি। কিন্তু মুজিব ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তার। কমান্ডার সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে জেলার কালিহাতী থেকে নৌকা নিয়ে দেড় শতাধিক মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ নিতে ভারতের মেঘালয়ে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন প্রায় সাড়ে ৩শ’ শরণার্থী। রংপুরে আরেক দল মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে দেখা। তিনি তখন “ছোটদের-বড়দের, সকলের। গরীবের-নিঃস্বের-ফকিরে। আমার এদেশ সকলের” দেশাত্মবোধক এই গানটি গাইছিলেন। মুক্তিবাহিনীর ওই দল চিনতে না পেরে তাদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এমন সময় ওই দলের কমান্ডার বাংলা গানের শব্দ পেয়ে বলেছিলেন, নৌকায় গান গাইলো কে? তখন তিনি এগিয়ে গেলেন। ওই কমান্ডার বললো তোর কারণে আজ সবাই বেঁচে গেলো। মেঘালয়ে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় সদস্য হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর। জেলার কাগমারী এলাকায় পত্যক্ষ যুদ্ধে ক্যামেরাবন্দি হন তিনি।

নুরে আলম বলেন, ‘ওই ছবিটি ক্যামারাবন্দি করা অজ্ঞাত সেই ফটোগ্রাফার বলছিলেন, যুদ্ধ করে তো আর কিছু পাবে না, ছবিটিই থাকবে। আজ তাই হলো ছবি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।’

বাসাইল উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘নুর আলম একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। ওই ছবিটিও নুর আলমের দাবি করে বলেন, ছবিটি আমাদের বাসাইলের গর্ব। এই ছবিকে সংরক্ষণ ও ছবির ওপর ভিত্তি করে একটি ভাস্কর্য তৈরির জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।
জেলার তিনটি উপজেলার এই আলোচিত মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি দিয়ে একটি করে ভাস্কর্য তৈরি করে তাদের স্মরণীয় রাখার দাবি জানান স্থানীয়রা।