তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের বিবাদে এবারও বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে আলাদাভাবে। এবার কোনও পক্ষেরই পাঁচ দিনের প্রস্তুতিমূলক সমাবেশ ‘জোড়’ ইজতেমা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়নি।
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা ইজতেমা পালন করবেন ১০, ১১ ও ১২ জানুয়ারি। আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ১২ জানুয়ারি (রবিবার) শেষ হবে প্রথম পর্বের ইজতেমা।
চার দিন বিরতি দিয়ে সা’দ কান্ধলভীর অনুসারীরা ইজতেমা পালন করবেন ১৭, ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি। আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ১৯ জানুয়ারি (রবিবার) সমাপ্তি ঘটবে ২০২০ সালের ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমা।
রবিবার সকালে ইজতেমা মাঠে গিয়ে দেখা যায়, কেউ খুঁটির ওপর চট টাঙাচ্ছেন, কেউ লোহার খুঁটি ও পাইপ দিয়ে মূল মঞ্চ তৈরি করছেন, কেউ টয়লেট নির্মাণের কাজ করছেন, কেউবা বালু দিয়ে মাঠ সমান করছেন। এছাড়া কেউ কেউ তাঁবু টাঙানো, নামাজের লাইন তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। দলবদ্ধ হয়ে ভাগ করে ইজতেমার প্রস্তুতিমূলক কাজ করছেন তারা।
ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের পারাপারের জন্য তুরাগ নদের ওপর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সাতটি ভাসমান সেতু তৈরির কাজও শেষ পর্যায়ে।
এছাড়া বিদেশি মুসল্লিদের থাকার জন্য ইজতেমা মাঠের উত্তর-পশ্চিম পাশে তুরাগ তীরে টিন-চট দিয়ে বিশেষ কামরা নির্মাণের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। বিদেশি আবাসনের পশ্চিমে তুরাগ পাড়ে তাদের রান্নার চুলা ও রন্ধনশালা নির্মাণ করা হচ্ছে।
টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ইতোমধ্যে ময়দানে তাঁবু টাঙানোর কাজ প্রায় শেষের দিকে। বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মীরা ময়দানে কাজ করছেন। সার্বিক কার্যক্রম প্রায় সম্পন্ন। উত্তরা, গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকা থেকে মুসল্লিরা সকাল থেকেই ইজতেমা মাঠে এসে মাঠ তৈরির কাজে যোগ দিচ্ছেন।
শ্রীপুর পৌরসভার ২নং সিএন্ডবি এলাকার বাসিন্দা নূরুল ইসলাম জানান, মহান আল্লাহ ও তার সন্তুষ্টি লাভে দল বেঁধে ইজতেমা মাঠে এসেছেন। সাথিদের নিয়ে তাঁবুর জন্য খুঁটি স্থাপনের কাজ করেছেন।
টঙ্গী এলাকার বাসিন্দা আমান উল্লাহ বলেন, জানমাল আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় ব্যয় করতে ইজতেমা মাঠে কাজ করতে এসেছি। আমাদের সঙ্গে প্রায় ৫০ জন সাথি ভাই রয়েছেন।
মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে বাটা গেট দিয়ে ইজতেমা মাঠের প্রবেশপথেই দেখা গেলো ১৫ থেকে ২০ জন লোক বাঁশ কাটছেন। কাটা বাঁশগুলো সারি বেঁধে তাঁবুর কাছে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য মুসল্লিরা। এরপর চট দিয়ে পরস্পরের সহযোগিতায় নির্মাণ করছেন শামিয়ানা।
ময়মনসিংহের তারাকান্দা থেকে আসা ২০ জনের একটি দল টানানো বাঁশে চট লাগাচ্ছেন। ওই দলের মুরব্বি আব্দুল জব্বার বলেন, ‘বিভিন্ন স্থান থেকে ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের যাতে কোনও কষ্ট না হয়, সেজন্য সবাই ছুটে এসেছি। সবাই এখানে স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে কাজ করছে।’
মাওলানা জুবায়ের পন্থীর ইজতেমা মাঠের মুরুব্বি প্রকৌশলী মফিজুর রহমান জানান, বিদেশি মেহমানদের জন্য আলাদা মঞ্চসহ বয়ানমঞ্চ প্রস্তুত করছেন তারা। মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজের ছাত্র ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে ইজতেমা মাঠে আল্লাহকে খুশি করতে কাজ করছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন ইজতেমা মাঠের উঁচু-নিচু জায়গা ও রাস্তাঘাট সমান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ইজতেমা ময়দানের শামিয়ানার কাজ প্রায় শেষের পথে। মুসল্লিদের যাতায়াতসহ ময়দানে সুযোগ-সুবিধায় তুরাগ নদে সেনাবাহিনী ভাসমান সেতুর কাজ করছে। একই সঙ্গে ইজতেমার মাঠজুড়ে বিদ্যুতের তার ও পানির পাইপ টানার কাজও চলছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিশেষ নিরাপত্তায় ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন করতে দেখা গেছে।
টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার পারভেজ আলম জানান, তাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মেডিক্যাল অফিসারদের তালিকা ও ডিউটি রোস্টার করা হয়েছে। মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে মন্নু গেট, এটলাস গেট, বাটা কারাখানার গেট ও টঙ্গী হাসপাতাল মাঠসহ ইজতেমা মাঠের আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হবে। ওইসব ক্যাম্পে হৃদরোগ, অ্যাজমা, ট্রমা, বার্ন, চোখ এবং ওআরটি কর্নারসহ বিভিন্ন ইউনিটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসাসেবা দেবেন। রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সও মোতায়েন থাকবে।
টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ‘ইজতেমার জায়গায় আমাদের একটি কন্ট্রোল রুমও স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে সার্বক্ষণিক কর্মকর্তাসহ ফায়ারম্যানরা থাকবেন। ময়দানের প্রতি খিত্তায় ফায়ার এস্টিংগুইসারসহ ফায়ারম্যান, গুদাম ঘর ও বিদেশি মেহমানখানা এলাকায় পানিবাহী গাড়ি, ডুবুরি ইউনিট, স্ট্যান্ডবাই লাইটিং ইউনিট এবং অ্যাম্বুলেন্স থাকবে।’
ডেসকো কর্তৃপক্ষ জানায়, ইজতেমা এলাকায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। মুসল্লিদের ব্যবহারের জন্য ইজতেমা ময়দান এলাকায় তিনটি গ্রিড থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। প্রস্তুত রাখা হবে চারটি শক্তিশালী জেনারেটর। ইজতেমা এলাকায় স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর এবং ট্রলি-মাউন্টেড ট্রান্সফরমারও সংরক্ষণ করা হবে।
টঙ্গী স্টেশন মাস্টার মো. হালিমুজ্জামান জানান, ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের জন্য ১০টি বিশেষ ট্রেন চালু করা হবে এবং সব ট্রেন টঙ্গীতে যাত্রাবিরতি করবে। রেলস্টেশনে তিন স্তরে টিকিট বিক্রি করা হবে। স্টেশনে মুসল্লিদের জন্য আলাদা অস্থায়ী বিশ্রামাগার ও ১০০টি টয়লেট তৈরির কাজ আগামী ২/৩ দিনের মধ্যে শেষ হবে।
গাজীপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের টঙ্গী অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, ইজতেমা মাঠে ১৭টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ওজু-গোসলের হাউস ও টয়লেটসহ প্রয়োজনীয় স্থানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে। ৩১টি টয়লেট ভবনে ৮ হাজার ৩৩১টি টয়লেট থাকবে। এর মধ্যে নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত অজু-গোসলখানা এবং টয়লেটগুলো ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দ্রুতগতিতেই ইজতেমার মাঠ প্রস্তুতির কাজ এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে মাঠের প্রায় ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি, এবারের ইজতেমা শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হবে।’
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) এসএম তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী ১০ জানুয়ারির আগেই বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ইতোমধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এখানে বিদ্যুৎ, পানি, প্যান্ডেল তৈরি, গ্যাস সরবরাহ প্রতিটি কাজই আলাদা আলাদা গ্রুপের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। এবার পুরো ইজতেমা ময়দানকে ৮৭টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। এতে ৬৪টি জেলার মুসল্লিরা খিত্তা অনুসারে অংশ নেবেন। এরমধ্যে ঢাকা জেলার জন্য ২৩টি খিত্তা এবং ময়মনসিংহ জেলার জন্য দুটি খিত্তা রাখা হয়েছে। বাকি সব জেলার জন্য একটি করে খিত্তা থাকবে।’
বাংলাদেশে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ১৯৬৩ সাল থেকে। জানুয়ারির ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ইজতেমা হবে ৫৭তম। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইজতেমা তিন দিন ধরে অনুষ্ঠিত হতো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মুসল্লিরা এই ইজতেমায় অংশ নেন বলে এটি বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে পরিচিতি পায়। পরে মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১০ সাল থেকে দুই দফায় তিন দিন করে ইজতেমার আয়োজন করা হতো। তাবলিগের আমির মাওলানা সা’দ কান্ধলভী ও মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীর বিরোধের কারণে গত বছর থেকে দুই পক্ষ তিন দিন করে আলাদাভাবে ইজতেমার আয়োজন করতে শুরু করে।