৪০ কেজি ওজনের একটি মাছকে ঘিরে ক্রেতাদের জটলা। মাছের নাম বাঘাআইড়। বিক্রেতা দাম হেঁকেছেন ৬৫ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে একজন মাছটির দাম সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা বলছেন। কিন্তু বিক্রেতা আরও বেশি দাম পাওয়ার আশায় ছাড়ছেন না। চলছে দর কষাকষি। যত না ক্রেতা তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসুক জনতা।
পৌষের শেষ দিন শুক্রবার (১৪ জানুয়ানি) গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের ত্রিমোহনার বিনিরাইল গ্রামে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলায় এই দৃশ্য দেখা গেছে। এটা মূলত জামাই মেলা। কিন্তু সবাই বলে মাছের মেলা। আর এই দিনটিকে ঘিরেই এখানে দিনব্যাপী চলে আনন্দ-উৎসব। দিনটির জন্য সারাবছর অপেক্ষায় থাকে স্থানীয়রা।
মাছের মেলা হলেও এখানে চলে এলাকার জামাইয়ের মাছসহ বড় জিনিস কেনার প্রতিযোগিতা। বিনিরাইল ও এর আশপাশে গ্রামে যারা বিয়ে করেছেন, সেসব জামাই মেলার মূল ক্রেতা ও দর্শনার্থী। এ ছাড়া মেলাকে ঘিরে এলাকার শ্বশুরদের মধ্যেও চলে এক নীরব প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতাটি হলো—কোন জামাই সবচেয়ে বড় মাছটি ক্রয় করে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে পারে। আবার শ্বশুররাও চান, কে সবচেয়ে বড় মাছটি ক্রয় করে জামাই আপ্যায়ন করতে পারে। বিনিরাইলের মাছের মেলা যেন জামাই-শ্বশুরের বড় মাছ কেনার প্রতিযোগিতার মাঠ।
এবারের মেলায় তিন শতাধিক ব্যবসায়ী বাহারি মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। মেলায় মাছ ছাড়াও আসবাবপত্র, খেলনা ও মিষ্টির পসরাও বসেছে। মাছের মেলায় সামদ্রিক চিতল, বাঘাআইড়, বোয়াল, কালী বাউশ, পাবদা, গুলসা, গলদা চিংড়ি, বাইম, কাইকলা ও রূপচাঁদা মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে নানা রকমের দেশি মাছও।
জামালপুর ইউনিয়নের কাপাইস গ্রামের জামাই হোসেন আলী বলেন, এবার সাড়ে ১৭ হাজার টাকার চিতল, বোয়াল ও আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনেছেন।
কলাপাটুয়া গ্রামের মতিউর রহমা বলেন, এবার সাড়ে ১৫ হাজার টাকার চিতল, বোয়াল ও আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনেছেন।
জামালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জানান, মাছের মেলাটি এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের ধারক। মেলায় বেচাকেনা যতই হোক, মেলা আমাদের ঐতিহ্য আর কৃষ্টি-কালচারকে বহন করছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা। তাই এখানে কোনও প্রকার দাঙ্গা-হাঙ্গামা নেই।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা থেকে মেলায় আসা মাছ ব্যবসায়ী নয়ন কুমার দাস জানান, তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে এই মেলায় দোকান করেন। বিনিরাইলের পাশেই চুপাইর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বসে তিন দিনব্যাপী মাছের মেলা। ইতিহাস ঐতিহ্যের কারণে বিনিরাইলে কেনার চেয়ে দেখতে আসা মানুষের ভিড় এখন বেশি। তাছাড়া স্থানীয় মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন হওয়াতে প্রতি বছর এ মেলায় যোগ দেন।
এবার মেলায় প্রচুর দেশি রুই, কাতল, বোয়াল, আইড়, বাঘাআইড়, চিতল, কালবাউশ ও রিটা মাছের সমাগম হয়েছে। এ ছাড়া কার্প জাতীয় নানা মাছের আমদানি হয়েছে। এক কেজি থেকে শুরু করে বিশ কেজি পর্যন্ত এসব মাছের দাম হাঁকা হচ্ছে ৪০০ টাকা থেকে ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। সামর্থ অনুযায়ী ক্রেতারা এসব মাছ কিনছেন।
মেলার আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জানান, এই মেলা কালীগঞ্জের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবে স্বীকৃত। এলাকার জামাইরা বলেন, শ্বশুরবাড়িতে মাছ নিয়ে যাওয়া বলে কথা। তাই এলাকার সকল জামাইয়ের নজর বিনিরাইলের মেলার বড় মাছটার দিকেই। তাই স্থানীয় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা সপ্তাহখানেক ধরে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে থাকেন। সেই অনুযায়ী মাছের দামও হাঁকানো হয়।
কমিটির সভাপতি ও ইউপি সদস্য কিশোর আকন্দ জানান, এই মেলাটি প্রথম অনুষ্ঠিত হতো খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে। এটা অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। প্রায় ২৫০ বছর ধরে আয়োজিত হয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেলাটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে।