স্বপ্নপূরণ করতে পারেনি সন্তানরা, ৫৫ বছর বয়সে ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছেন বাবা

ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিবারে অভাব থাকায় লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় মোহাম্মদ বেলায়েত শেখের। সংসারের খরচ বহন করতে গিয়ে পড়াশোনার বয়স পার হয়ে যায়। তবে পড়াশোনা করার স্বপ্ন লালন করে গেছেন। এবার স্বপ্নপূরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন ৫৫ বছর বয়সী বেলায়েত।

সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ১১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষ) ‌‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবেন তিনি। বেলায়েত গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কেওয়া পশ্চিম খন্ড (দারোগারচালা) এলাকার মৃত হাছেন আলী শেখের ছেলে। তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক।

বেলায়েত জানান, জীবনের এই সময়ে এসে এমন একটি সাহসী ও বিস্ময়কর পদক্ষেপ নেওয়ার পেছনের গল্পটি ছিল চ্যালেঞ্জিং। নিজের ভাইদের থেকে শুরু করে সন্তানদেরও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করাতে না পারার অভিমান ও ক্ষোভ থেকেই এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। শৈশব থেকে লেখাপড়া করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন। পরে নিজের সন্তানের সঙ্গে স্কুলে ভর্তি হন। কখনও বাবার অসুখ, কখনও বৃদ্ধ মা অসুস্থ। সব মিলিয়ে ইচ্ছা থাকার পরও সঠিক সময়ে লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। 

তিনি বলেন, ‘আগে থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করবো। আমার পরিবারেরও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তখন আমার বাবার সংসারে অভাব থাকায় লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারিনি। পরে আমি অনেক কষ্ট করে টাকা-পয়সা জমিয়ে নিজের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করি। ১৯৮৩ সালে এসএসসি পরীক্ষার আগে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফরম পূরণের টাকা দিয়ে বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে পরীক্ষা দিতে পারিনি। পাঁচ বছর পর ১৯৮৮ সালে আবার প্রস্তুতি নিই। কিন্তু সে বছর বন্যার কারণে ডুবে যায় স্বপ্ন। ফলে এসএসসি পাস করা হয়নি। এরপর আবারও প্রস্তুতি নিই। আবারও বিফল হই।’

বেলায়েত বলেন, ‘১৯৯১-৯২ সালের দিকে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন মা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমার হাতে যা টাকা ছিল সবটুকু মায়ের চিকিৎসায় ব্যয় করি। ফলে সেবারও পরীক্ষা দিতে পারিনি। পরে আমি আমার ভাইদের লেখাপড়ার দিকে নজর দিই। ভাইদের একজন এসএসসি পর্যন্ত পড়েছে, অন্যজন তাও করেনি। পরে তাদের ব্যবসায় মনোযোগী করে তুলি। তারা এখন ব্যবসা করে ভালোভাবে সংসার চালায়।’

তবে এটুকুতে থেমে থাকেননি বেলায়েত। ভাইদের পরে দায়িত্ব নেন দুই ছেলে ও এক মেয়েকে শিক্ষিত করে তোলার। বড় ছেলে শিপন শেখ (২৫), মেয়ে বিপাশা শেখ (২১) এবং ছোট ছেলে সাদেক শেখ জীবন (১৭)। কিন্তু ছেলেমেয়েরাও তার আশা পূরণ করতে পারেনি। বড় ছেলে এবং বড় মেয়ে অনার্স প্রথমবর্ষে দুই সেমিস্টার পরীক্ষা দিলেও পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। এরপর সবকিছু পেছনে ফেলে পড়ালেখার জন্য তৈরি হন বেলায়েত।

পড়ালেখা করার ইচ্ছার বিষয়ে জানতে চাইলে বেলায়েত শেখ বলেন, ‘সন্তানদের ওপর অভিমান করে পড়াশোনা শুরু করেছি। আমার ছোট ছেলে যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে আমি তখন নবম শ্রেণিতে ভর্তি হই। ওই সময় আমার বয়স ৫০ বছর। ৫২ বছরে এসে আমি এসএসসি পাস করি। এসএসসিতে জিপিএ ৪.৪৩ এবং এইচএসসিতে ৪.৫৮ পয়েন্ট পেয়ে উত্তীর্ণ হই। দুটো মিলে ৯.১ পয়েন্ট হয়। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার পয়েন্ট আমার আছে, তাই আবেদন করলাম। এখন পরীক্ষা দেবো।’

তিনি বলেন, ‘আমার ভেতরে যে শিক্ষা অর্জনের ইচ্ছা ছিল সেটা থেকেই মূলত লেখাপড়া শুরু করেছি। পরিবারের সবাই আমার জন্য দোয়া করছেন।’

বেলায়েত আরও জানান, তিনি দৈনিক করতোয়ার গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার স্বপ্ন থেকে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষধভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটে আবেদন করেছেন। তিনি ২০১৯ সালে রাজধানীর বাসাবোর দারুল ইসলাম আলিম মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং ঢাকা মহানগর কারিগরি কলেজ থেকে চলতি বছরে এইচএসসি পাস করেন।