অর্থের অভাবে হচ্ছে না গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভ

স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুর দিকে ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোয়ালন্দ মহকুমার গুরুত্বপূর্ণ গোয়ালন্দ ঘাট দখল নেওয়ার চেষ্টা চালায়। ওই সময় ইপিআর, আনসার ও ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে পড়ে তারা। প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন আনসার কমান্ডার ফকির মহিউদ্দিন, ছবেদ আলী, হাবিল মন্ডল, কবি তোফাজ্জল হোসেনসহ বেশ কয়েকজন। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ওই প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ ও গণহত্যার শিকার স্থানীয়দের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হয়নি। ২০১৯ সালে স্মৃতিস্তম্ভের বিথ্তিপ্রস্তর স্থাপন হলেও অর্থের অভাবে সেটির নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। 
 
স্থানীয়রা জানান, হানাদার বাহিনী ওই দিন গোয়ালন্দে প্রবেশ করে নিরস্ত্র মানুষের ওপর ব্যাপক গণহত্যা চালায় ও আগুন দিয়ে গোয়ালন্দ বাজারসহ কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এই যুদ্ধের ভেতর দিয়েই পাকিস্তানি বাহিনী রাজবাড়ী ও ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করে। 

স্থানীয়রা জানান, ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল ভোরে আরিচাঘাট থেকে একটি গানবোট, একটি কে-টাইপ ফেরি, কয়েকটি স্পিড বোট ও হেলিকপ্টার যোগে হানাদার বাহিনী তৎকালীন গোয়ালন্দ মহাকুমার উজানচর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে নামার চেষ্টা করে। তখন মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ, ইপিআর, আনসার, ইপিআর কমান্ডার এসডিও শাহ ফরিদ, তৎকালীন থানা ছাত্রলীগ সভাপতি ফকির আব্দুল জব্বার ও সাধারণ সম্পাদক কেরামত আলি প্রামানিকের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। 

যুদ্ধে শহীদ হন ফকির মহিউদ্দিন, ছবেদ, হাবিল, কবি তোফাজ্জলসহ আরও অনেকে। সেদিন বাহাদুরপুর ও গোয়ালন্দ বাজার পাকিস্তানিরা আগুনে জ্বালিয়ে দেয়।

হানাদারের বুলেটে শহীদ হন বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের জিন্দার আলী মৃধা, জয়নদ্দিন ফকির, নায়েব আলী বেপারি, মতিয়ার বেগম, কদর আলী মোল্লা, মোলায়েম সরদার, হামেদ আলী শেখ, কানাই শেখ, ফুলবুরু বেগম, বুরুজান বিবি, কবি তোফাজ্জল হোসেন, আমজাদ হোসেন, আলেয়া খাতুন, মাধব বৈরাগী, আহাম্মদ আলী মণ্ডল, খোদেজা বেগম, করিম মোল্লা, আমোদ আলী শেখ, কুরান শেখ, মোকসেদ আলী শেখ, নিশিকান্ত রায়, মাছেম শেখ, ধলাবুরু বেগম, বাহেজ পাগলাসহ নাম না জানা আরও অনেকে। সেই থেকে ২১ এপ্রিল গোয়ালন্দ প্রতিরোধ দিবস হিসেবে বিবেচনা করে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন। 

রাজবাড়ী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিরোধ যোদ্ধা ফকির আব্দুল জব্বার বলেন, ২১ এপ্রিল ছিল বুধবার। ভোরে হানাদার বাহিনী গোয়ালন্দ আক্রমণ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিল তা ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে। আমাদের হালকা অস্ত্রের প্রতিরোধ আধা ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয়নি। সেই যুদ্ধে আমার চাচা আনসার কমান্ডার ফকির মহিউদ্দিন শহীদসহ কয়েকজন শহীদ হন। মূলত ওই দিনই আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়।

এদিকে ২১ এপ্রিলের প্রতিরোধ যুদ্ধস্থলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে বাহাদুরপুরের ইউসুফ আলী মাস্টার জমি দান করে। পরে ওই জমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জেলা পরিষদ থেকে পাওয়া দুই লাখ টাকায় প্রাথমিক ভিত্তি প্রস্তরের কাজ করা হয়। পুরো কাজ শেষ করতে আরও অন্তত ২৪ থেকে ২৫ লাখ টাকা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক প্রকৌশলী শেখ জুয়েল বাহাদুর বলেন, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। রাজবাড়ী জেলা পরিষদ থেকে পাওয়া দুই লাখ টাকায় প্রাথমিক ভিত্তি প্রস্তরের কাজ করা হয়েছে। পুরো কাজ শেষ করতে আরও ২৪ থেকে ২৫ লাখ টাকা প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজ শেষ হলে নতুন প্রজন্ম ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিলের ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারবে। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা ও নির্মমতার বিষয়টিও অনুধাবন করতে পারবে। আমরা পাকিস্তানের নির্মমতা সম্পর্কে সবাইকে জানাতে চাই। তবে দুঃখের বিষয়, অর্থের অভাবে নির্মাণের কাজ শেষ কো সম্ভব হচ্ছে না।