নিহতদের স্বজনরা বলছেন, চোরাকারবারিদের খপ্পরে পড়েই সোহেল রানা (১৬) ও হারুন আলী (১৫) নিহত হয়েছে। শুধু সোহেল রানাই নয়, অনেক শিশুকেই এ কাজে জড়ানো হচ্ছে। সীমান্তের মানুষের মধ্যে এ নিয়ে আতঙ্কও সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
বুধবার (২১ জুন) রাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাদের লাশ বিজিবির কাছে ফেরত দেয়। পরে বিজিবি সদস্যরা উভয় পরিবারের অভিভাবকদের কাছে লাশ হস্তান্তর করে। রাত ১১টার দিকে নিজ নিজ গ্রামে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়।
বিজিবির খোসালপুর ক্যাম্প কমান্ডার আবু তাহের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুই কিশোরকে টাকার লোভ দেখিয়ে প্রলুব্ধ করতে পারে বলে ধারণা করছি।’
সোহেলের মামা হাসানুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি একটি দুর্ঘটনা। খারাপ লোকদের সঙ্গে জড়িয়ে তার ভাগ্নে ভারতে গিয়েছিল।’ তিনি দাবি করেন সে গরু আনতে যায়নি। তাদের পরিবার মোটামুটি স্বচ্ছল। তাদের জমিতে ধান পাট, তামাক ও ধনে পাতার আবাদ হয়। কেন সে গরু আনতে ভারতে যাবে। সোহেলকে বিএসএফ গুলি করে ও শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
শ্যামকুড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমান উল্লাহ বলেন, ‘যারা ভারতে যায়, তারা কোনও না কিছু আনতে যায়।’ তবে হারুন নামের ওই ছেলে এর আগে ভারতে গিয়েছিল কিনা তা তিনি নিশ্চিত নন বলে জানান।
শ্যামকুড় ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বিষারত আলী বিষু বলেন, ‘একটি চক্র প্রলোভন দেখিয়ে ভারত থেকে গরুসহ অবৈধ মালামাল আনার জন্য শিশুদের ব্যবহার করছে। কিন্তু হারুন কখনও ভারতে গরু আনতে যায়নি।’
হারুনের মা জাহিনুর বেগম জানান, রবিবার (১৮ জুন) সকালে হারুন বাড়ি থেকে বের হয়। মঙ্গলবার (২০ জুন) সকালে ভারত থেকে তার কাছে ফোন করে হারুন। মাকে ফোন করে সে জিজ্ঞাসা করে ঠিকমত ওষুধ খাচ্ছে কিনা? সেই কথাই ছিল হারুনের শেষ কথা। পরে তারা জানতে পারেন ভারতে বিজিবির গুলিতে হারুন মারা গেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘তার ছেলে গরুর পারাপারের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। এক বছর আগে বিভিন্ন গরু ব্যাপারীর সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলার শিয়ালমারী বাজারে একই জেলার দর্শানার ডুগডুগি বাজারে ও ফরিদপুর জেলার টেপাখোলা বাজারে গরু নিয়ে যেতো। পরে সে নিজ গ্রাম শ্যামকুড়ের এনামুল হকের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে পার্টনারে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে। তার ছেলে কখনও ভারতে গরু আনতে যায়নি। সে ভারতে গেছে, বাড়ির কেউ তা জানতোও না। কারা তাকে ভারতে গরু আনতে পাঠিয়েছে তাও পরিবারের সদস্যরা বলতেও পারেননি।
হারুনের পরিবারের দাবি, ‘তাদের ছেলেকে শুধু গুলি করে নয়, নির্যাতন করা হয়েছে। পরে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়।’
সোহেল রানার বাবা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার আগের রাতে সে বাড়িতেই ছিল। ভোরে ওঠে দেখেন সোহেল নেই। পরে দুপুরের দিকে জানতে পারেন, তার ছেলে ভারতে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে।’ তিনি দাবি করেন, তার ছেলে কখনও ভারতে গরু আনতে যায়নি। কারা তাকে নিয়ে গিয়েছিল তাও তিনি জানেন না।’ সোহেল রানা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে বলেও তিনি জানান।
সীমান্ত এলাকার আহসান হাবিবসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, ঘটনার দিন একই সঙ্গে ২০ থেকে ২৫ জন ব্যক্তি খোশালপুর সীমান্ত দিয়ে গরু আনতে ভারতের কুমারী গ্রামে যায়। সেখান থেকে অন্য সবাই পালিয়ে আসলেও বিএসএফের গুলিতে হারুন ও সোহেল রানা নিহত হয়।
তাদের অভিযোগ মহেশপুরের শ্যামকুড়, পলিয়ানপুর, বাগাডাঙ্গা, খোশালপুর সীমান্ত দিয়ে অবাধে চোরাচালান হচ্ছে। ঈদ ও বিশেষ বিশেষ উৎসবের আগে চোরাচালান বেশি হয়। এসব কাজে সীমান্ত এলাকার ছোট ছোট ছেলেদের ব্যবহার করা হয়। চোরাচালানের সঙ্গে বিজিবি ও বিএসএফের কিছু অসাধু সদস্যরাও জড়িত। তাদের সহযোগিতায় চোরাচালান হয়।
শ্যামকুড় ও খোশালপুর এলাকার গ্রামগুলো ভারত সীমান্তে। বাংলাদেশ ছোট্ট ইছামতি নদী পার হলেই ওপারে ভারত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রামের একাধিক ব্যক্তি জানান, এপার বাংলাদেশ সীমান্তে খোশালপুর আর ওপারে ভারতের নদীয়া জেলার কুমারী এলাকা। সামান্য কাঁটাতার বেষ্টিত কুমারী গ্রামে প্রায় শতাধিক পরিবার বসবাস করে। ভারতের লোকজন সেখানে ভারতীয় পণ্য নিয়ে রেখে দেয়। পরে সময় ও সুযোগমতো নদী পার হয়ে তা চোরাই পথে বাংলাদেশে নিয়ে আসে।
শুধু শিশুরাই নয়, গরু ব্যবসায়ীদের অনেকেই বিভিন্ন সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে নিহত হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন জানান, গত ছবছরের ৫ আগস্ট ভোর রাতে মহেশপুরের বাঘাডাঙ্গা সীমান্তে বিএসএফএর গুলিতে আলম (২৬) নামে এক বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী নিহত হন।এখন শিশুদের এ কাজে জড়ানো হচ্ছে— আর তারা নিমর্মভাবে খুনের শিকার হচ্ছে। অথচ কিছুই করা যাচ্ছে না।
/এনআই/এসএমএ/